
গাছের গায়ে ফুটে থাকা এক নিঃশব্দ উপাসনা নাগলিঙ্গম ফুল, যেন শিবলিঙ্গকে ঘিরে জাগ্রত এক ফুলেল প্রার্থনা। - রিজওয়ান করিম
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃক্ষ, তার ডালে-গাঁটে ঝুলে থাকা শত শত রক্তিম ফুল। এ যেন নিসর্গের বুকে লেখা এক দেবগাথা। নাম—নাগলিঙ্গম। শুনলেই যেন মনের ভেতর ধ্বনিত হয় শিবমন্ত্র, চোখে ভেসে ওঠে মন্দিরের ধোঁয়া, আর নাকে লাগে এক পবিত্র গন্ধের আভাস।
নাগলিঙ্গম শুধু একটি ফুল নয়, এটি এক আধা-ঐশ্বরিক চিহ্ন, এক অলৌকিক উপস্থিতি, যাকে প্রকৃতি নিজ হাতে নির্মাণ করেছে শতাব্দীর শিল্পানুভূতি দিয়ে।
নাগলিঙ্গম ফুলের সৌন্দর্য এককথায় রূপকথার মতো। পাপড়ির গড়ন গোল, রঙে রক্তিম, মাঝে ধবধবে সাদা। অথচ তার কেন্দ্রস্থলে যেন নাগফণার মতো গঠন, আর তার মধ্যেই অবস্থান করছে একটি লিঙ্গাকৃতি স্তম্ভ। কেউ বলবে, এ তো একদম শিবলিঙ্গ! তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই ফুলের মাহাত্ম্য অনন্য।
এ ফুলের ঘ্রাণ সাধারণ নয়। এক ধরনের ঘোর লাগানো গন্ধ, যা ধূপ বা চন্দনের মতো তীব্র, একধরনের পূজার আবেশ তৈরি করে। ফুলটি দিনের বেলায় ফোটে, সন্ধ্যার আগে ঝরে পড়ে। ঠিক যেন কোনো ক্ষণস্থায়ী অলৌকিকতা, যার বেঁচে থাকা মানেই প্রার্থনার মুহূর্ত।
নাগলিঙ্গমের নামেই আছে দুটি শক্তিশালী প্রতীক—নাগ এবং লিঙ্গ। সাপ ও শিবলিঙ্গ দুটিই হিন্দু ধর্মে শক্তি, ধ্যান ও ধ্বংসের প্রতীক। তাই অনেক মন্দিরে এই গাছকে পূজার অংশ হিসেবে রাখা হয়। গাছটির নিচে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা ভক্তদের দৃশ্য দেখা যায় ভারতের বহু পুরাতন আখড়ায়। এটি যেন বৃক্ষের শরীরে ফুটে থাকা এক স্থায়ী মন্দির। জীবনের ক্ষণস্থায়ীতার মাঝে এক চিরন্তন উপস্থিতি।
এই ফুলকে সহজেই রূপক হিসেবে ব্যবহার করা যায় সৌন্দর্য ও মৃত্যুর সহাবস্থান, ধর্ম ও প্রকৃতির মেলবন্ধন, কিংবা ঈশ্বর ও মানুষের মাঝখানের অদৃশ্য সেতুবন্ধন হিসেবে।
যে কবি অবলোকন করেন, তার চোখে নাগলিঙ্গম হয়ে ওঠে "ধূপে মোড়ানো একটি প্রার্থনার পঙ্ক্তি", আর যে চিত্রকর একে আঁকেন, তার তুলিতে ধরা পড়ে এক আধ্যাত্মিক বিস্ময়।
নাগলিঙ্গম ফুল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রকৃতি কখনও শুধু গাছ, ফুল বা ফল নয়; তা এক এক সময় হয়ে ওঠে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ও নান্দনিকতার সমন্বিত প্রতিমা। এই ফুল আমাদের চোখে, মনে ও বিশ্বাসে রেখে যায় এক গভীর রেখা, যা শুধু সৌন্দর্যের নয়, তা চেতনারও।
নাগলিঙ্গম তাই একটি ফুল নয়, এক নিঃশব্দ ধ্যান।
এক ফুলে জেগে ওঠে ঈশ্বর, শিল্প ও স্মৃতির স্বর।
শিহাব