
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার অ্যারেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নে মরিচ শুকাচ্ছেন চাষি
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদী ওপারে বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে...।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই যেন তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার এপার ওপার। তিন নদ-নদী বেষ্টিত উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলা। এ জেলার চার উপজেলা ঘিরে রয়েছে ১৬৫টি চর ও দ্বীপ। বন্যা ও নদীভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে চরবাসী তাদের কোমড় শক্ত করেছেন। ফসলের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে তাদের রঙিন জীবন। মসলা ফসলের লালমরিচ তাদের রাঙিয়েছে। এ যেন চরবাসীদের মহাকাব্য। যে কাব্যে রয়েছে ভাওয়াইয়া গানের কথা ও সুর। আবার নুরুলদিনের সাড়া জাগানো ধ্বনি ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবায়।’ কৃষিতে জেগে উঠেই এই চরবাসী বিছিয়েছে অপরূপার সবুজ ও লালগালিচা।
উত্তরাঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানে বলা হয়
কাইঞ্চাইত গাড়িনু আকাশি আকালি,
আকালি ঝুম ঝুম করে রে বন্ধুয়া, আকালি ঝুম ঝুম করে...
ভাওয়াইয়া এই গানের অর্থটি দাঁড়ায় আকালি অর্থ মরিচ আর কাইঞ্চা মানে হলো উঠান। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গাইবান্ধার ফুলছড়িহাট। যা লাল মরিচের এক জীবন্ত উঠান। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে জমে ওঠে এক অনন্য বাণিজ্যের মহাযজ্ঞ, যেখানে চরের কৃষকের পরিশ্রম আর ব্যবসায়ীদের উদ্যম মিলে তৈরি করে কোটি টাকার লেনদেন। গাইবান্ধার বিখ্যাত স্লোগান ‘স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরীর ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ’ এই হাট যেন মরিচের গন্ধে ভাসা এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। গাইবান্ধার লাল মরিচ বা শুকনা মরিচের কদর ও চাহিদা দেশব্যাপী রয়েছে।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর ৫ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন শুকনা মরিচ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জেলার ৭ উপজেলায় ২ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। যার ৮০ শতাংশই চাষ হয়েছে ফুলছড়ির চরাঞ্চলে। এর বাজার মূল্য আনুমানিক ১১০ থেকে ১১৫ কোটি টাকা। ফুলছড়ির এই লালমরিচ শুধু রান্নাঘরের রং বা স্বাদের জিনিস নয়। এটি হাজারো কৃষক পরিবারের রুজি-রুটি জোগানোর উৎস, জীবন এগিয়ে নেওয়ার সাহস। তাদের চাষ, সংগ্রাম ও শ্রমে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই মরিচ বাজার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হাটের রূপ বদলাতে পারে, কৃষকের ঘরে ফিরতে পারে প্রত্যাশার আলো।
২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মরিচ চাষ করে আসছেন ফুলছড়ি উপজেলার এ্যারেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের আলগারচরের মোন্নাফ গাজী। তিনি এ বছরও চার বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে মরিচ চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এবার কাঁচা অবস্থায় প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ৩০-৪০ মণ করে মরিচের ফলন হয়েছে। শুকানোর পর বিঘাপ্রতি ফলন টিকছে ১০ থেকে ১২ মণ। কিন্তু এবার দাম কম।
তাই তার মনও ভার। তিনি অভিযোগ করলেন কাঁচা মরিচ কিনছেন মাত্র ৭/৮ টাকা কেজি। মরিচ শুকিয়ে বিক্রি করতাম তিনশ’ টাকা কেজি। এবার ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি। একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। আমরা কিছুই বলতে পারি না। সরকারিভাবে নজরদারি নেই বলে সিন্ডিকেট যখন যা তাই করছেন বলে অভিযোগ তার।
ভোরের আলো ফুটতেই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একের পর এক ভেসে আসে নৌকা। নৌকায় সাদা বস্তার ভেতর গায়ে গায়ে ঠাসা টকটকে লাল মরিচ যেন আগুনঝরা কোনো শস্যের উৎসব! গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার পুরানো হেডকোয়ার্টার এলাকায় বসা মরিচের এই হাট যেন শুধু বেচাকেনার জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে জীবন-জীবিকার এক চিরচেনা কেন্দ্র। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে, এই হাটে বছরের পর বছর ধরে কোটি টাকার লেনদেন হলেও হাটের নেই স্থায়ী কোনো ঠিকানা। বসতে হয় ভাড়া করা জায়গায়। নেই বিশ্রামাগার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উপজেলা প্রশাসন বলছে, খুব দ্রুতই একটি উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে হাটের পরিবেশ উন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও সদর এই চার উপজেলার চরজুড়ে বছরের পর বছর ধরে চাষ হয় শুকনা মরিচ। কৃষক বলেন, মাটি যেমন উর্বর, তেমনি নদীর পানি দেয় জীবনীশক্তি। মরিচের গায়ে যেন সেই ঋতুর স্পর্শ! আর চরের ফসলের গন্তব্য হলো এই ফুলছড়িরহাট। সপ্তাহে দুই দিন শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। নদীপথে ভেসে আসেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
কেউ মাথায় বস্তা নিয়ে, কেউবা ঘোড়ার গাড়িতে বোঝাই মরিচ এনে হাজির হন হাটে। নদীর পাড়ে ভিড়ছে নৌকা, নিচ্ছে মরিচভর্তি বস্তা। চোখে-মুখে ঘাম ও স্বপ্ন নিয়ে নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও হাত লাগাচ্ছে মরিচ নামানোর কাজে। একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে হাঁটছিলেন খোলাবাড়ি গ্রামের কৃষক সাদেকুল। মুখে ক্লান্তি, কিন্তু তাতে গর্বও মেশানো। বললেন, চার বিঘা জমিতে মরিচ করেছিলাম, ফলন ভালো। দামটা আরেকটু ভালো হলে চরের লোকজন হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। হাটজুড়ে কেবল দামদর নয়, আলোচনায় উঠে আসে মরিচের মান। মান ভেদে তিন ভাগে ভাগ উত্তম, মধ্যম, নিম্ন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, ফুলছড়ির মরিচ মানে এক রকম গ্যারান্টি। প্যাকেটজাত খাবারের কোম্পানিরাও এখান থেকে সরাসরি মরিচ কিনে নিয়ে যায়। নওগাঁ থেকে আসা ব্যবসায়ী শাহা পরাণ সুলতান বললেন, আমি গত ১০ বছর ধরে এই হাটে মরিচ কিনছি। দেশের অন্য কোথাও এত ভালো মানের শুকনা মরিচ পাইনি। তবে এতে ভালো মানের মরিচের বাজারদর কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। রতনপুরের আজগর আলী বলেন, গত বছর বিক্রি করেছি ১২ হাজারে, এবার পাইকাররা বলছে ৫ হাজার!
এত কম দামে আমরা কীভাবে খরচ তুলব? শুধু আজগর নন, হাটজুড়ে কৃষকের মুখে একই সুর- ফলন ভালো, দাম খারাপ। বছরের পর বছর ধরে কোটি টাকার লেনদেন হলেও হাটের নেই স্থায়ী কোনো ঠিকানা। বসে ভাড়া করা জায়গায়। নেই বিশ্রামাগার, নাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফুলছড়ি হাটের ইজারাদার অহিদুল ইসলাম বললেন, এখানে সরকারি খাস জমি রয়েছে। চাইলে ভরাট করে হাটসেড, গোডাউন, শৌচাগার বানানো সম্ভব। তাতে ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পাবেন, সরকারও রাজস্ব পাবে। পাইকাররাও একই কথা বলছেন। বগুড়া থেকে আসা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, রাতে থাকি কোথায়? হাটে ঘুমানোর জায়গা নেই। অথচ লাখ লাখ টাকার লেনদেন করি আমরা।
এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু ম-ল বলেন, ফুলছড়ির মরিচের হাট গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী একটি হাট। তা ছাড়া মরিচ গাইবান্ধার একটি ব্র্যান্ড পণ্য। কৃষকের ঘামের এই পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর। খুব দ্রুতই একটি উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে হাটের পরিবেশ উন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বলা যেতে পারে প্রান্তিক চাষিরা এই হাটকে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হিসেবে দেখেন। তারা আশা করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মরিচ চাষ আরও লাভজনক হবে। হাটের অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিপণন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা গেলে এই হাট শুধু গাইবান্ধারই নয়, সমগ্র উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। মরিচের এই হাট যদি আরও সুসংগঠিত হয়, তবে দেশের মসলা বাজারে গাইবান্ধার নামটি হয়ে উঠবে আরও উজ্জ্বল।
ফুলছড়ি হাট শুধু একটি স্থানীয় বাজার নয়, এটি হয়ে উঠেছে গাইবান্ধার কৃষি অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখানকার লাল মরিচ শুধু ঝালই জোগায় না, জোগায় হাজার হাজার কৃষক পরিবারের অন্নসংস্থান। ‘চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ’ যেমন গাইবান্ধার গর্ব, তেমনি এই হাট গাইবান্ধার অর্থনীতির অহঙ্কার। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সহযোগিতা পেলে এই হাট একদিন দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে গাইবান্ধার নাম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে।