ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

ঢাকার আকাশে ধুলোর মেঘ, মাটিতে সবুজের আর্তনাদ

এলেন বিশ্বাস, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা 

প্রকাশিত: ০২:০৪, ১৪ জুলাই ২০২৫

ঢাকার আকাশে ধুলোর মেঘ, মাটিতে সবুজের আর্তনাদ

ছবি: জনকণ্ঠ

কিছুটা বৃষ্টি হলে ধুলাবালি বসে, কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। ঢাকার বাতাস যেন আর মুক্ত নয়—ধুলোয় আচ্ছন্ন এক বিষাক্ত পরিমণ্ডলে পরিণত হয়েছে এ নগর। প্রতিদিন সকাল হলেই রাজধানীর রাস্তায়, ফুটপাতে, ভবন নির্মাণস্থলে আর খোলা জায়গায় দেখা যায় ধুলোর রাজত্ব। সেই ধুলোর ঘন মেঘ ঢেকে দেয় আকাশ, আর নিঃশব্দে কাঁদে মাটি—কারণ সে হারিয়েছে তার সবুজ সন্তানদের।

একসময় যে ঢাকা ছিল ছায়াঘেরা রাস্তাঘাট, গাছের সারি আর খোলা জায়গায় ভরপুর, আজ তা হারিয়ে গেছে কংক্রিটের জঞ্জালে। দ্রুত নগরায়নের নামে বৃক্ষনিধন, সড়ক খনন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থা, নির্মাণকাজের ধুলাবালি আর নাগরিক উদাসীনতা মিলে ঢাকার পরিবেশকে করে তুলেছে বসবাসের অযোগ্য।

ধুলায় ঢাকা আকাশ: নিশ্বাসেও বিষ

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় প্রায়শই উঠে আসে ঢাকার নাম। ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ (AQI)-এর হিসেবে বহুদিন ধরেই ঢাকা রয়েছে শীর্ষে বা শীর্ষের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাতাসে PM2.5 ও PM10 ধুলিকণার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের জন্য এই ধুলা ও দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্রেস্ট অ্যান্ড লাং ফাউন্ডেশনের মতে, শীত ও গ্রীষ্মকালে রাজধানীর হাজারো মানুষ অ্যাজমা, সিওপিডি, এলার্জি ও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার একটি বড় কারণ হলো এই ধুলাবালিময় পরিবেশ।

সবুজ নিধনের নীরব কান্না

ঢাকার প্রতিটি এলাকায় এখন চলছে এক নির্মাণযজ্ঞ। অথচ পরিকল্পনার অভাবে নগর উন্নয়নই হয়ে উঠেছে পরিবেশ ধ্বংসের হাতিয়ার। উন্নয়নের নামে গাছ কাটা হচ্ছে, পার্ক ও খোলা জায়গা কমে আসছে, ছায়া হারিয়ে ফেলছে শহর।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে ঢাকার শত শত প্রাচীন বৃক্ষ নিধন হয়েছে শুধু সড়ক উন্নয়ন বা অবকাঠামো সম্প্রসারণের নামে। সেগুলোর জায়গায় কোনো বিকল্প গাছ লাগানো হয়নি বা হলেও তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টিকছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর নেতারা বলছেন, শহরের গাছপালা কেটে ফেলার ফলে শুধু ছায়াই হারায়নি, বেড়েছে তাপমাত্রা, বাতাসে ধুলার পরিমাণ এবং বৃষ্টির পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থার বিঘ্ন।

প্রকল্পের ধুলো, নীতিহীন নির্মাণ

রাজধানীজুড়ে চলছে সড়ক সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), ভবন নির্মাণসহ নানা প্রকল্প। কিন্তু এসব কাজের মধ্যে পরিবেশবান্ধব কোন ব্যবস্থাপনাই চোখে পড়ে না।

নির্মাণকাজে পানি ছিটিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণের নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোলা ট্রাকে করে বালি, ইট, সিমেন্ট পরিবহন করা হয়, যাতে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ধুলোর সৃষ্টি হয়। রাস্তার পাশে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা নির্মাণসামগ্রীও ধুলোর বড় উৎস।

মাটির প্রতিবাদ: নিঃশব্দ, তবুও গভীর

যেখানে এক সময় ছিল মাঠ, পার্ক, উদ্যান—সেই জায়গাগুলো এখন দখল হয়ে গেছে ভবন, মার্কেট, পার্কিং, সেমিনার হল কিংবা বাণিজ্যিক স্থাপনায়। নগরের প্রাণ, তার সবুজ পরিসর হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

“এটি একটি পরিবেশগত ট্র্যাজেডি,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান। “সবুজ হারালে শহর হারায় তার শ্বাস, হারায় তার আত্মা।”

একই কথা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। “নগর শুধু কংক্রিট নয়, একটি জীবন্ত সত্তা। সে যদি নিঃশ্বাস নিতে না পারে, তাহলে সেখানে মানুষও টিকবে না,” বলেন নগর গবেষক স্থপতি এম. জে. ফারুক।

সমাধান কোথায়?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যার সমাধান আছে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া তা সম্ভব নয়। কিছু প্রস্তাব হচ্ছে:

  • নির্মাণস্থানে ধুলো নিয়ন্ত্রণে পানির ছিটানো ও ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
  • সবুজায়নের জন্য প্রতিটি নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে বৃক্ষরোপণ বাধ্যতামূলক করা।
  • খোলা জায়গা ও মাঠ সংরক্ষণ করতে হবে।
  • নগর পরিকল্পনায় পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নকে প্রধান বিবেচনায় রাখতে হবে।

আজকের ঢাকা কেবল একটি শহর নয়, এক আশঙ্কার প্রতীক—যেখানে মানুষ ধুলোতে পথ হারায়, সবুজ হারিয়ে ফেলে প্রাণের স্পন্দন। আকাশে ধুলোর ভার যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধের নিদর্শন, আর মাটির সবুজ-হারানোর আর্তনাদ সেই যুদ্ধে পরাজিত প্রকৃতির কান্না।

এই নগরের ভবিষ্যৎ রক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা, পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। নইলে একদিন এই ধুলোয় ঢেকে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎও।

শহীদ

×