ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

হিজাব ও বোরকা: আধুনিক নারী ও ইসলামী চেতনার মেলবন্ধন

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ৩০ জুলাই ২০২৫

হিজাব ও বোরকা: আধুনিক নারী ও ইসলামী চেতনার মেলবন্ধন

ছবি : মডেল আনিসা ইসলাম ঐশী

ইসলাম ধর্মে নারীর পোশাক সংক্রান্ত যে নির্দেশনা রয়েছে, তা মূলত শালীনতা, আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে নির্ধারিত। এই নির্দেশনার বাস্তব প্রকাশ ঘটে বোরকা ও হিজাবের মাধ্যমে। হাজার বছরের ধর্মীয় ইতিহাস, সামাজিক বাস্তবতা এবং আধুনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই দুটি পোশাক মুসলিম নারীর জীবনে এক বিশেষ অবস্থান অর্জন করেছে। একে কেবল ধর্মীয় অনুশাসন হিসেবে দেখলে এর গভীর তাৎপর্য পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। এটি একইসঙ্গে একটি বিশ্বাস, চেতনা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক।

বোরকা হলো এমন একটি পোশাক, যা একজন নারীকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখে। এতে শরীরের আকৃতি দৃশ্যমান হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রেই মুখ আবৃত থাকে। অন্যদিকে হিজাব সাধারণত মাথা, চুল, কান ও গলা ঢেকে রাখে, যদিও মুখ খোলা থাকে। অনেকের কাছে হিজাব মানে কেবল একটি স্কার্ফ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পোশাকের ধারণা—যেখানে পোশাকের শালীনতা, দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ এবং আচরণের পরিপূর্ণতা একত্রে অন্তর্ভুক্ত।

পবিত্র কোরআনে নারীদের পর্দা করার নির্দেশ স্পষ্টভাবে উল্লিখিত। সুরা আন-নূর (২৪:৩১)-এ বলা হয়েছে, “মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে যা আপনা-আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে, এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষে আচ্ছাদন করে।” সুরা আহযাব (৩৩:৫৯)-এও বলা হয়েছে, “হে নবী, তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের উপর ঝুলিয়ে নেয় তাদের চাদর, যাতে তারা চিহ্নিত হয় এবং যেন তাদের কষ্ট না দেওয়া হয়।” এই আয়াতগুলোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারীকে পরিচিত ও সম্মানিত করার জন্য এবং তাকে অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি ও হয়রানি থেকে রক্ষার্থে পর্দার বিধান এসেছে।

তবে এই পোশাক ব্যবস্থাকে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে বাস্তবতা ধরা পড়ে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিজেদের ইচ্ছায় হিজাব বা বোরকা পরিধান করেন, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান ও আত্মনিয়ন্ত্রণবোধ বেশি দেখা যায়। এটি মানসিক নিরাপত্তা ও আত্মিক প্রশান্তি এনে দেয়। পশ্চিমা অনেক দেশে, যেখানে হিজাব বা বোরকা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে, সেখানে বহু নারীই নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার অংশ হিসেবে এই পোশাক পরিধান করেন। ফলে এটি নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, বরং তাদের সচেতন ও স্বাধীন পছন্দেরই প্রতিফলন।

পোশাকের মাধ্যমে একটি সমাজব্যবস্থাও প্রতিফলিত হয়। মুসলিম সমাজে হিজাব বা বোরকা শুধু একজন নারীর ব্যক্তিগত পরিচয়ের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সামষ্টিক বিশ্বাস, চেতনা ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এটি ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক এবং পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনের একটি উপাদান। এটি অশ্লীলতার বিরুদ্ধে একটি মৌন প্রতিবাদ—যা ভাষাহীন হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী।

তবে সমাজে এই পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োগ এবং ব্যাখ্যায় বৈচিত্র্য বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কিংবা ইউরোপে বসবাসরত মুসলিমদের মধ্যে এই পোশাক ব্যবহারের রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে। কেউ তা কঠোরভাবে অনুসরণ করেন, আবার কেউ আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রহণ করেন। বর্তমানে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ইসলামিক পোশাককে আধুনিক নকশায় উপস্থাপন করছে, যা ধর্মীয় বিধান বজায় রেখে একজন নারীর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়।

অতএব, ইসলামিক পোশাক—বিশেষ করে বোরকা ও হিজাবকে কেবল ধর্মীয় অনুশাসন বা প্রথা হিসেবে দেখা যাবে না। এটি নারীর আত্মসম্মান, নিরাপত্তা, বিশ্বাস এবং সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটি শুধুই শরীর ঢাকার নয়, বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি জীবনদর্শন এবং আত্মপরিচয়ের জোরালো ঘোষণা। বিশ্বের নানা প্রান্তে মুসলিম নারীরা যখন স্বেচ্ছায় এই পোশাক বেছে নিচ্ছেন, তখন এটি একটি মৌলিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিদর্শন হিসেবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য।

আবির

×