
ছবি: সংগৃহীত
এক সময় ঢাকার অলিগলিতে, পার্কের পাশে কিংবা সড়কের পাশে বসে একতারা হাতে বাউল কিংবা পথশিল্পীদের গান শোনা যেত। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি এমন গভীরতর গানের ধ্বনি যেন হৃদয়ের গভীরে গিয়ে ছুঁত। কিন্তু এখন আর সেই সুর, সেই দোহার সঙ্গ, কিংবা মাটির গন্ধমাখা গলা—শুনতে পাওয়া যায় না। একতারা যেন আজ শুধু স্মৃতির যন্ত্র, আর পথগান রয়ে গেছে পুরনো দিনের গল্পে।
হারিয়ে যাওয়া লোকগানের শহর
ঢাকায় আগে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি কিংবা পুরান ঢাকার অলিগলিতে পথগায়কদের দেখা মিলত। তারা মাটির গান গাইত, তাদের গানে ছিল সমাজ, প্রেম, দুঃখ, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার গল্প। তারা চায়নি কোনো স্টেজ, মাইক বা বাজনার বাহার। শুধু একতারা বা ডুগডুগি হাতে গেয়ে যেতেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গান।
কিন্তু এখন শহরজুড়ে শুধু গাড়ির শব্দ, রাজনৈতিক স্লোগান, আর কর্পোরেট গানের আধিপত্য। লোকগানের জাদু যেন ঢাকা পড়ে গেছে কৃত্রিমতার পর্দায়।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে?
বাউল বা পথগায়কদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।
১. জীবিকা নির্বাহের কষ্ট: গান গেয়ে যে আয় হতো, তা দিয়ে আজকাল পরিবার চালানো প্রায় অসম্ভব।
২. শ্রোতার অভাব: মানুষ এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান শোনে না। স্মার্টফোনে ইউটিউবের দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে মাটির সুর।
৩. নগরায়ন ও আইন: অনেক জায়গায় পথগায়কদের বসতে দেওয়া হয় না। পার্কে, রাস্তায় গান গাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বাঁধা এসেছে।
৪. পরবর্তী প্রজন্মের অনাগ্রহ: সন্তানদের কেউ আর বাউল হতে চায় না। পরিবার চায় সন্তান পড়াশোনা করে চাকরি করুক, পৈতৃক গানের পথ যেন বেকারত্বের সিঁড়ি।
বেঁচে থাকার লড়াই
বাউল রশিদ ঢাল বলেন, আমরা এখন বাউলই, তাও লুকিয়ে। আগে যেখানে ২০টা গান গেয়ে ২০০-৩০০ টাকা পেতাম, এখন মানুষ সময়ই দেয় না। টাকার বদলে দেয় করুণা।”
বাউলদের জীবনযাপন শুধু গান নয়, এটা ছিল এক দর্শন—জীবন, মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা। সেই দর্শন এখন বাণিজ্যের জালে আটকে গেছে।
কী করা দরকার?
এই সংকট থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন
-
লোকগানকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা
-
বাউল ও পথশিল্পীদের জন্য সরকারি ভাতা বা প্রণোদনা চালু করা
-
শহরে নির্ধারিত ‘লোকসংগীত কর্নার’ চালু করা, যেখানে নিয়মিত গান পরিবেশনের সুযোগ থাকবে
-
টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে লোকসংগীত প্রচারে উদ্যোগ নেওয়া
ঢাকা আজ আধুনিক শহর। কিন্তু একতারা, দোতারার সুর হারিয়ে গেলে এই শহর শুধু কংক্রিট হয়ে থাকবে—মানুষের না, মেশিনের।
একতারা হয়তো আজ বাজে না, কিন্তু সুর তার এখনো বেঁচে আছে কিছু হৃদয়ে। সেই হৃদয়গুলোর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে শহরের পথঘাট। নয়তো লোকগানের শহর ঢাকা হয়ে থাকবে নিছক স্মৃতি।
আবির