
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেষ সময়ের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা, আন্দোলন দমন এবং রক্তাক্ত সংঘর্ষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
“হাসিনা—জুলাইয়ের ৩৬ দিন” শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেন, যার প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ঘটে যায় ভয়াবহ সহিংসতা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছরের শাসন শেষে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দাবি করা হয়, তিনি ভেবেছিলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব।
আল জাজিরার দাবি, তাদের হাতে থাকা গোপনে রেকর্ডকৃত ফোনালাপে শোনা যায় শেখ হাসিনা ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বলছেন, "আমার নির্দেশনা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আমি খোলা আদেশ দিয়েছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে গুলি চালাবে।"
আরেকটি ফোনালাপে দাবি করা হয়, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ে আন্দোলন দমন করা হয়েছিল।
প্রামাণ্যচিত্রে একাধিক চিকিৎসকের স্বাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে, যারা জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার গুলিতে বহু বিক্ষোভকারী নিহত ও আহত হন। আল জাজিরার তথ্যমতে, ওই আন্দোলনের তিন সপ্তাহে অন্তত ১ হাজার ৫০০ জন নিহত, ২৫ হাজারের বেশি আহত এবং প্রায় ৩০ লাখ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ পেয়েছে, ছাত্র আবু সাইয়েদের হত্যাকাণ্ডকে চাপা দিতে সরকারের ভয়ভীতি ও ঘুষ প্রয়োগের চিত্র।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাঁচবার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বদলানোর চেষ্টা করেন, যাতে গুলির অস্ত্রের কথা লুকানো যায়।
"সায়েদ বলছিলেন— গুলি করো, গুলি করো— এবং বুক উন্মুক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রথমে পেটে গুলি লাগে, পরে বুকে।"
তার মৃত্যুর ঘটনা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা ‘আমরা সবাই আবু সায়েদ হবো’ এই শপথ নেয়। তাই টার মৃত্যুর কারণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে শেখ হাসিনা।
নিহত সাইয়েদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে বাধ্য করা হয়, যা ছিল একপ্রকার প্রচারণামূলক রাজনৈতিক চাপ।
প্রকাশিত গোপন নথিতে দেখা যায়, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্ববাসীর কাছে সহিংসতার সত্য চিত্র পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করেছিল।
তবে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা কখনোই প্রাণঘাতী অস্ত্রের নির্দেশ দেননি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র তাপসের সঙ্গে কথিত ফোনালাপের সত্যতাও তারা অস্বীকার করেছেন।
আবু সাইয়েদের পরিবার যদি কোনো ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকে, তার জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করে। তারা আরও দাবি করে, আন্দোলনকারীদের সংঘাত ও সহিংসতার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ রাখতে হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষ স্বীকার করে এখন রাষ্ট্রের সাক্ষী।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবির কর্মকর্তারা এই প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই অডিও রেকর্ডিং "জাল, বিকৃত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।" তারা দাবি করে, তাদের নির্দেশ ছিল "সবসময় সংযম বজায় রাখা।"
প্রতিবেদনের শেষে, আল জাজিরা জানায়, ডকুমেন্টারিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের সবার মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশই সাড়া দেননি।
সানজানা