
ছবিঃ সংগৃহীত
আজকের দৌঁড়ঝাঁপের জীবনে, হৃদযন্ত্রের ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়া, অর্থাৎ ক্রনিক হার্ট ফেইলিওর (CHF), একটা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এমন এক সমস্যা যা হঠাৎ হয় না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে—অধিকাংশ সময় নিজের অজান্তেই। ভয়ংকর বিষয় হলো, রাতে ঘুমের সময় এই সমস্যা অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠতে পারে।
রাতে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, শরীর বিশ্রামে চলে যায়। কিন্তু সেই সময়েই অনেকের শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা দুর্বল হৃদপিণ্ডের জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাতে হৃদপিণ্ডের সমস্যা কেন বাড়ে?
১. শরীরের ভেতরে তরল ওঠানামা করে
দিনে পায়ে যে জল জমে থাকে, রাতে শুয়ে পড়লে তা বুকে উঠে আসে। এতে ফুসফুসে চাপ পড়ে, আর যাদের হার্ট দুর্বল, তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
২. হৃদস্পন্দন কমে যায়
ঘুমের সময় স্বাভাবিকভাবেই হৃদপিণ্ড ধীরে কাজ করে। কিন্তু CHF থাকলে এই ধীরগতি আরও বড় সমস্যা ডেকে আনে।
৩. বারবার ঘুম ভেঙে বাথরুমে যাওয়া
রাতে শরীরের তরল নিঃসরণ বাড়ে। CHF রোগীদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি হয়—ঘন ঘন প্রস্রাবের জন্য ঘুমে বিঘ্ন ঘটে।
৪. অক্সিজেনের ওঠানামা
ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হলে শরীরে অক্সিজেন কমে যায়। যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে, তাদের ক্ষেত্রে হার্টে আরও বেশি চাপ পড়ে।
CHF-এর রাতের সময়ের লক্ষণ যেগুলো আমরা প্রায়ই অবহেলা করি
- শুয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া – হয়তো অনেক বালিশ ছাড়া ঘুমানোই যায় না।
- মাঝরাতে হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া।
- বুকে চাপ বা অস্বস্তি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন।
- একটানা ঘুমের পরও সকালে ক্লান্ত লাগা।
- ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া।
এই উপসর্গগুলো হয়তো ছোটখাটো বলে মনে হয়, কিন্তু অবহেলা করলে এর ফল হতে পারে মারাত্মক।
পুরুষদের বেশি ঝুঁকি কেন?
গবেষণা বলছে, ৪৫-এর আগ পর্যন্ত পুরুষদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ৫০ পার হওয়ার পর নারী-পুরুষ সমান ঝুঁকিতে পড়েন। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পর হরমোনের পরিবর্তনের ফলে হৃদরোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
হার্ট ফেইলিওরের বিভিন্ন ধাপ এবং রাতের প্রভাব
প্রথম ধাপ: দিনের বেলা কিছু বোঝা না গেলেও রাতে হালকা শ্বাসকষ্ট বা বারবার বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
মাঝারি ধাপ: শুয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, ঘন ঘন কাশি বা দমবন্ধ হয়ে ঘুম ভাঙে।
চরম ধাপ: একেবারেই শুয়ে থাকা যায় না, ঘন ঘন হার্টের সমস্যা হয়। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি বা হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হতে পারে।
রাতে হার্ট সুস্থ রাখতে কী করবেন?
মাথা একটু উঁচু করে ঘুমান – একাধিক বালিশ বা অ্যাডজাস্টেবল বেড ব্যবহার করুন।
ঘুমের আগে খুব বেশি জল খাবেন না – বারবার বাথরুমে যেতে হবে না।
খাবারে লবণের পরিমাণ কমান – এতে শরীরে জল কম জমে, হার্টের উপর চাপও কমে।
ঘুমের সময় ঠিক রাখুন – প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান ও উঠুন।
ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন – উপসর্গ থাকলে দেরি না করে পরামর্শ নিন।
জীবনধারায় কিছু ছোট পরিবর্তন বড় বিপদ ঠেকাতে পারে
হালকা ব্যায়াম (যেমন হাঁটা বা যোগব্যায়াম) হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো।
ধূমপান ও মদ্যপান বাদ দিন – এগুলো ঘুম ও হার্ট, দুইয়েরই ক্ষতি করে।
স্ট্রেস কমান – ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ এসব খুব কাজে দেয়।
প্রয়োজনে ঘুমের স্টাডি করান – স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে সেটা শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ক্রনিক হার্ট ফেইলিওর নীরব ঘাতক—এই কথা একেবারে মিথ্যে নয়। কারণ, এটা চুপিচুপি শরীরের ক্ষতি করতে থাকে। অনেকসময় আমরা ভাবি, একটু ক্লান্তি বা একটু শ্বাসকষ্ট বুঝি বাড়তি পরিশ্রমের ফল। কিন্তু যদি রাতের ঘুম ঠিক না হয়, ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয়, কিংবা শুয়ে দম বন্ধ হয়ে যায়—তাহলে সতর্ক হওয়া খুবই জরুরি।
সময়মতো ব্যবস্থা নিলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। তাই নিজেকে বুঝুন, লক্ষণগুলো চিনুন, আর প্রয়োজনে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, সুস্থ হৃদয়ই শান্ত ঘুমের চাবিকাঠি।
মারিয়া