
উষ্ণ ও আর্দ্র উপক্রান্তীয় আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশের গবাদিপশু খাতে হিট স্ট্রেস একটি ক্রমবর্ধমান সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি লাইভস্টক ও পোলট্রির স্বাস্থ্যের অবনতি, উৎপাদন কমে যাওয়া, রোগপ্রবণতা বৃদ্ধি এবং কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র খামারিরা, যাদের অধিকাংশেরই আধুনিক, আবহাওয়া-নিয়ন্ত্রিত খামার পরিচালনার সুযোগ নেই।
এই প্রতিকূল বাস্তবতায় এক সাহসী ও যুগান্তকারী উদ্ভাবন এসেছে একজন তরুণ গবেষকের হাত ধরে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) স্নাতকোত্তর গবেষক আল মোমেন প্রান্ত উদ্ভাবন করেছেন একটি কম খরচের, স্বয়ংক্রিয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তি, যা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লাইভস্টক ও পোলট্রির হিট স্ট্রেস নিরীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সক্ষম।
এই সিস্টেমে ব্যবহৃত হয়েছে সহজলভ্য পরিবেশগত সেন্সর, যা গবাদিপশুর আশেপাশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপ করে। প্রাপ্ত তথ্য ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (আইওটি)-এর মাধ্যমে ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে প্রেরণ হয়, যেখানে তাপমাত্রা-আর্দ্রতা সূচক (THI) — পশুর তাপচাপ নির্ধারণে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি সূচক তাৎক্ষণিকভাবে গণনা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় মডেল ব্যবহার করে হিট স্ট্রেসের স্তর নির্ধারণ করা হয়।
তবে উদ্ভাবনের আসল বিশেষত্ব এখানেই নয়। এই সিস্টেমে রয়েছে একটি অন্তর্নির্মিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল, যা THI বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়। হিট স্ট্রেসের মাত্রার উপর ভিত্তি করে সিস্টেমটি নিজে থেকেই এগজস্ট ফ্যান চালু বা বন্ধ করে দেয়, যাতে আশেপাশের পরিবেশ দ্রুত নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পশুরা আরামে থাকতে পারে। এছাড়া, পোলট্রির ক্ষেত্রে সিস্টেমটিতে ব্যবহার করা হয় কুলিং প্যাড।
তার এই গবেষণার পেছনে ছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. রকিবুল ইসলাম খান-এর একান্ত তত্ত্বাবধান এবং সহকারী অধ্যাপক এস. এম. আরিফুল ইসলাম-এর দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ।
এই সিস্টেম শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল অঞ্চলেও কার্যকরী হতে পারে। এর স্কেলযোগ্য ডিজাইন সহজেই বিভিন্ন ধরনের খামারে ও পশুর প্রজাতিতে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে সাব-সাহারান আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার পাহাড়ি অঞ্চল যেখানেই গবাদিপশু ও পোলট্রির জন্য জলবায়ু চ্যালেঞ্জ আছে, সেখানেই এটি হতে পারে একটি সাশ্রয়ী সমাধান।
এটি আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা যেমন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs)-এর সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষত ক্ষুধা নিরসন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সাশ্রয়ী উদ্ভাবন সংক্রান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে। এটি খামারে পশু মৃত্যুহার কমিয়ে, উৎপাদন খরচ না বাড়িয়ে, পশুকল্যাণ ও কৃষক-আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ইতোমধ্যে গবাদিপশু উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাবের কথা বলেছে। তাই, এখন আর এই ধরনের প্রযুক্তি বিলাসিতা নয়, বরং একান্ত প্রয়োজনীয়তা।
যেখানে খামার ব্যবস্থাপনার স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, এবং প্রতিটি সিস্টেম বাস্তবায়নে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা, সেখানে যেসব খামারির সেই সামর্থ্য নেই। বিশেষত মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক খামারিদের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এমন প্রযুক্তি সাধারণত বড় খামার, কোম্পানি বা উন্নত দেশের জন্য কল্পনা করা হয়; কিন্তু এবার সেটি এসেছে দেশি চিন্তা, দেশি উদ্ভাবন, আর কৃষকের জন্য ভাবা এক তরুণের হাত ধরে।
আল মোমেন প্রান্তের উদ্ভাবন আমাদের শেখায় বিশ্বমানের সমাধান সব সময় দামী যন্ত্রপাতি বা বিদেশি গবেষণার ফল নয়, অনেক সময় তা জন্ম নেয় সীমিত সম্পদের মাঝেও, যেখানে হৃদয়ের গভীর থেকে আসে একটি লক্ষ্য— প্রযুক্তি হোক সাধারণ মানুষের জন্য।
এম.কে.