ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

ঘড়ির কাঁটা ও জীবন

মো. আল হাদী

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ৩০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৮:৪৪, ৩০ জুলাই ২০২৫

ঘড়ির কাঁটা ও জীবন

রহিম সাহেব ঘড়ি দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর কব্জিতে সবসময় একটা ঝকঝকে ঘড়ি শোভা পায়, আর ঘরের  দেয়ালে, টেবিলের ওপর এমনকি মোবাইল ফোনেও ঘড়ির ডিসপ্লে অন থাকে। কিন্তু তাঁর এই ঘড়িপ্রীতি কেবলই একটা শখের মতো, কারণ সময়ের কাঁটার সঙ্গে তাঁর জীবনের গতির কোনো সখ্য নেই। সময় ৭টা ২০। আজ সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। সকাল ৮টার ট্রেন ধরার কথা, কিন্তু তিনি সবে মাত্র লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরছেন। স্ত্রী ফরিদা বেগম বহু আগেই তৈরি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন। ‘এই যে শুনছো, সাড়ে ৭টা বাজে। আর কতক্ষণ?’ ফরিদা বেগম বিরক্তির সুরেই বললেন। ‘ধুর! আর দুটো মিনিট। আমি আসছি,’ বলেই রহিম সাহেব দৌড় লাগালেন বাথরুমের দিকে। সময় ৮টা বেজে ১০ মিনিট। প্রতিদিন ট্রেন আসতে ৫-১০ মিনিট এমনিই লেইট করে। কিন্তু আজ কীভাবে যেন সময়মতো এসে পড়েছিল। এবং যথারীতি ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। অতঃপর কোনোমতে হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠলেন, সারাপথ দাঁড়িয়ে যেতে হলো, আর এই ধকলে মিটিংয়ে পৌঁছাতে দেরি হলো প্রায় এক ঘণ্টা। হাতেগোনা কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেই মিটিং শেষ করতে হলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না। রহিম সাহেবের ছোট বোন, লতা। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আজ তার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় সকাল ১০টা। লতা যথারীতি ঘুম থেকে উঠেছে নয়টায়। ‘আরেকটু ঘুমাই, কী হবে আর দুটো মিনিট,’ মনে মনে ভাবলো লতা। ঘুম ভাঙতেই ঘড়িতে দেখল সাড়ে ৯টা বাজে। ধড়মড় করে উঠে পড়লো সে। রিকশা পেতে দেরি, জ্যামে আটকে আরও দেরি। যখন হলে পৌঁছাল, তখন পরীক্ষার প্রথম ঘণ্টা শেষ। তাড়াহুড়োয় সে অনেক জানা প্রশ্নের উত্তরও ঠিকমতো লিখতে পারল না। ফলাফল, খারাপ পরীক্ষা।
শুধু রহিম সাহেব বা লতার গল্প নয়, এই চিত্র বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। সরকারি অফিসের কথা না বললেই নয়। সকাল ৯টায় অফিস শুরু। কিন্তু অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী আসেন এগারোটা, সাড়ে এগারোটায়। কাজ শুরু হয় আরও দেরিতে। নাগরিক সেবা নিতে আসা মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।  বাস, ট্রেন, প্লেন মিস করাটা যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ‘আর দু’মিনিট,’ ‘আরেকটু পরে’, ‘আজকের কাজ কালকে করবো’, এই মানসিকতা যেন বাঙালির রক্তে মিশে গেছে। সময় যে জীবনের চেয়েও মূল্যবান, সময়ের এক ফোঁড় যে অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। এই সহজ সত্যটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। সময়কে অবজ্ঞা করে আমরা নিজের অজান্তেই পিছিয়ে যাচ্ছি জীবনের দৌড়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে তার নিজস্ব গতিতে, কিন্তু আমরা যেন আজও সময়ের কদর করতে শিখলাম না। বাঙালি কবে বুঝবে, সময়ের সঙ্গে তাল না মেলালে শুধু ব্যক্তিগত জীবনই নয়, গোটা জাতিই এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াবে? দাঁড়াবে? নাকি ইতোমধ্যে দাঁড়িয়েছে?
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে

প্যানেল/মো.

×