ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

যুব সমাজ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

সাদিয়া ইসলাম কাসফিয়া

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ৩০ জুলাই ২০২৫

যুব সমাজ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

একটি জাতির প্রাণশক্তি, তার অগ্রযাত্রার মূল চালিকা শক্তি হলো তার যুব সমাজ। উদ্যম, স্বপ্ন, কর্মপ্রেরণা আর সম্ভাবনায় ভরপুর এই তরুণ প্রজন্মই এক নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু এদের অনেকেই আজ এক নিঃশব্দ যুদ্ধে জর্জরিত-যেখানে অস্ত্র নেই, শব্দ নেই, অথচ ধ্বংসের পরিমাণ মারাত্মক। এই যুদ্ধের নাম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। যার একটি বিশাল অংশের বয়স ১৫-২৯ বছরের মধ্যে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই বয়সী তরুণদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণই হচ্ছে আত্মহত্যা। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৪৬ শতাংশ তরুণ-তরুণী কোনো না কোনো পর্যায়ের বিষণ্নতায় ভুগছে, অথচ এদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ চিকিৎসা নিচ্ছে বা কাউন্সেলিং করছে।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এক মেধাবী শিক্ষার্থী তার মেসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার ডায়েরিতে পাওয়া যায়, ‘সবাই ভাবে আমি ভালো আছি, কিন্তু আমি কেমন আছি তা কেউ জানতে চায় না’। এই বাক্যটি যেন আজকের হাজারো যুবকের মনের অদৃশ্য আর্তনাদ।
বর্তমানে প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, সামাজিক চাপ, বেকারত্ব, পরিবারিক অস্থিরতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা- এসব কারণে যুব সমাজ ক্রমাগত মানসিক চাপে ভুগছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা চাকরির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার দৌড়ে তারা হারিয়ে ফেলছে নিজের অস্তিত্ব ও মানসিক প্রশান্তি। করোনাভাইরাস মহামারির পর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকা, অনলাইন শিক্ষা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আর্থিক অনিশ্চয়তা অনেক যুবকের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা তৈরি করেছে। অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যুব সমাজের মধ্যে বর্তমানে নানাধরণের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়, যেমন:
বিষণ্নতা; দীর্ঘমেয়াদি মনমরা ভাব, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, আত্মঘাতী চিন্তা, উদ্বেগজনিত ব্যাধি; অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, সামাজিক পরিস্থিতিতে অস্বস্তি, প্যানিক অ্যাটাক ইত্যাদি, তাছাড়া অ্যাসেসিয়াল বা একাকিত্ববোধের মধ্যে রয়েছে বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব, আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি, নিজেকে গুটিয়ে রাখা। আবার, মানসিক প্রশান্তি খোঁজার নামে বর্তমানে যুবকরা অনেক সময় মাদকে জড়িয়ে পড়ে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে যাতে করে সর্বোপরি, আত্মহত্যা করার প্রবণতা বাড়ছে। জৈবিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবসহ যুবকদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলোর বিকাশে অসংখ্য কারণ রয়েছে। জেনেটিক্স ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট কিছু মানসিক রোগে আক্রান্ত করার ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করে, যখন প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা, ট্রমা, ধমক এবং পারিবারিক কর্মহীনতা ঝুঁকির কারণগুলোকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাছাড়া, প্রতিনিয়ত পারিবারিক দ্বন্দ্ব কলহ, সামাজিক চাপ ‘অন্যরা কত ভালো করছে’ এই চাপে নিজের সক্ষমতা অবমূল্যায়িত হওয়া এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি হওয়া, একাডেমিক স্ট্রেস; নম্বরের দৌড়, ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা এবং ব্যর্থতার ভয়, সোশ্যাল মিডিয়া; ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে অন্যের ‘সফল’ জীবন দেখে নিজেকে ব্যর্থ ভাবা এবং সমবয়সী সম্পর্কগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে তরুণদের মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, অপর্যাপ্ততা, বিচ্ছিন্নতা এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলতে পারে। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ধারাবাহিক বৃদ্ধি পেলেও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ কার্যকর হস্তক্ষেপ এবং সমর্থনকে বাধা দেয়। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোতে সীমিত অ্যাক্সেস, বিশেষ করে অনুন্নত সম্প্রদায়গুলোতে, যত্নের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে, অনেক যুবককে পর্যাপ্ত সমর্থন ছাড়াই রেখে দেয়। তদুপরি, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার বিভক্ততা এবং অপর্যাপ্ত অর্থ মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও চাপ দেয়, সময়মতো হস্তক্ষেপ এবং চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত করে।
যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্য মোকাবিলার জন্য একটি ব্যাপক, বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা প্রতিরোধ, প্রাথমিক হস্তক্ষেপ এবং অ্যাক্সেসযোগ্য সহায়তা পরিষেবাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও ক্লাস চালু করা, টেলিভিশন, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কনটেন্ট তৈরি করার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা বাড়াতে হবে, যেন কেউ সংকোচ না বোধ করে।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও করপোরেট অফিসে পেশাদার সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পেশাদার সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (যেমন : মনের বন্ধু, কান পেতে রই) আরও উন্নত করে তোলা, হেল্পলাইন ও মোবাইল অ্যাপে দ্রুত মানসিক সহায়তার মাধ্যমে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। তাছাড়া পরিবারে সন্তানদের মানসিক অবস্থা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা দরকার। পরিবারে সহানুভূতি, মনোযোগ ও ভালোবাসা দিয়ে মানসিক সমর্থনের পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। 
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা আরও কার্যকর করে, বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র জেলা পর্যায়ে গড়ে তোলা শিক্ষা কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে রাখতে পারে মানসিকভাবে সুস্থ, সুন্দর ও প্রাণবন্ত।  আজকের বিশ্বে শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও সুস্থ থাকা একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ সমাজ যদি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে তা শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, সমাজ ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লজ্জা বা সংকোচ নয়, বরং সাহসিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে এগিয়ে আসার সময় এখনই।
আমরা যদি চাই এক সুস্থ, সাহসী, সৃজনশীল এবং সহানুভূতিশীল প্রজন্ম তবে তাদের মানসিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্ধকারে কান্না করা নয়, আলোয় এসে বলা উচিত- ‘আমি ঠিক নেই’ এবং সমাজকেও বলতে হবে- ‘তুমি একা নও, আমরা পাশে আছি’।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিদ্যালয়, ঢাকা

প্যানেল/মো.

×