
ছবি: সংগৃহীত
একটা সময়ের ভয়ংকর শিকারি টাইরানোসরাস রেক্স (টি. রেক্স)-এর পূর্বপুরুষ হিসেবে একটি নতুন ডাইনোসরের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ‘খানখুলু মঙ্গোলিয়েনসিস’ নামের এই ডাইনোসর ছিল ছোট আকৃতির, কিন্তু তার গুরুত্ব বিশাল—এটি টাইরানোসরের বিবর্তনের একটি অনুপস্থিত অংশ পূরণ করতে পারে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, এই প্রজাতিটি প্রায় ৮৬ মিলিয়ন বছর আগের এবং এটি টি. রেক্স-এর সবচেয়ে কাছের পূর্বপুরুষদের একটি হতে পারে। খানখুলুর নামকরণ করা হয়েছে ‘মঙ্গোলিয়ার ড্রাগন প্রিন্স’ হিসেবে, কারণ এটি ততটা বিশাল ছিল না যেমনটি আমরা টি. রেক্স-কে চিনি—‘টাইরান্ট লিজার্ড কিং’ নামে।
পুরনো হাড়ের ভাণ্ডার থেকেই নতুন ইতিহাস!
এই গবেষণার ভিত্তি ছিল ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে মঙ্গোলিয়ার গবি মরুভূমিতে পাওয়া দুটি আংশিক কঙ্কাল। আধুনিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এরা ছিল এমন এক মধ্যবর্তী রূপ যেখান থেকে টাইরানোসরের জায়ান্ট রূপ গড়ে ওঠে।
গবেষণার সহলেখক ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগারির অধ্যাপক ডার্লা জেলেনিটস্কি বলেন, ‘খানখুলুর আবিষ্কার আমাদের টাইরানোসরের পারিবারিক গাছ একেবারে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে।’
ছোটখাটো ‘ড্রাগন প্রিন্স’ থেকে দৈত্যাকার টি. রেক্স!
খানখুলু ছিল মাত্র ৪ মিটার লম্বা এবং ওজন ছিল আনুমানিক ৭৫০ কেজি। তুলনায় টি. রেক্স-এর ওজন ছিল প্রায় ৬ হাজার কেজি পর্যন্ত। খাঁজকাটা দাঁত, বিশাল মাথা আর ক্ষুদ্র হাতবিশিষ্ট ভয়ংকর টি. রেক্স একসময় উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার শীর্ষ শিকারি ছিল।
‘খানখুলু অনেকটা ঘোড়ার পাশে দাঁড়ানো হাতির মতো—টি. রেক্স-এর উরুর উচ্চতায় পৌঁছাতো মাত্র,’ বলেন জেলেনিটস্কি। খানখুলুর চোখের চারপাশে টি. রেক্স-এর মতো শিং বা উঁচু অংশ ছিল না, এবং তার ঠোঁটের হাড় ছিল ফাঁপা।
মহাদেশজুড়ে ‘ডাইনোসরের অভিবাসন’ ছিল বিবর্তনের চালিকাশক্তি
গবেষণায় আরও জানা যায়, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে তিন দফায় ডাইনোসরের অভিবাসন ঘটেছিল। ৮৫ মিলিয়ন বছর আগে খানখুলু বা তার কাছাকাছি কোনো প্রজাতি সাইবেরিয়া ও আলাস্কার মধ্যে থাকা স্থলসেতু দিয়ে আমেরিকায় চলে আসে। এরপর টাইরানোসরের নানা প্রজাতি বিশালাকৃতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে টি. রেক্স জন্ম নেয়।
৭৮ মিলিয়ন বছর আগে আবারও একটি প্রজাতি এশিয়ায় ফিরে যায় এবং দু’টি আলাদা শাখায় ভাগ হয়ে যায়—একটি ছিল বিশালাকার এবং অন্যটি ছিল তুলনামূলক ছোট ও চিকন, যাদের বলা হয় ‘পিনোকিও রেক্স’। এরা আজকের আফ্রিকার হরিণ বা শিয়ালের মতো মধ্যম স্তরের শিকারি ছিল।
জেলেনিটস্কি বলেন, “এই পিনোকিও রেক্সরা আগেও ছিল, কিন্তু আমরা দেখলাম তারা প্রকৃতপক্ষে টাইরানোসরের ‘ছোট ভার্সন’—যারা তাদের শরীর নিজেই ছোট করে নিয়েছিল।”
গবেষণা বলছে, ‘আমরাও যেভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছি, টাইরানোসররাও তেমন করেই ছড়িয়েছিল’
বিশেষজ্ঞ ক্যাসিয়াস মরিসন (ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন) বলেন, ‘এই নতুন আবিষ্কার টাইরানোসরের বিবর্তনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় স্পষ্ট করছে, যেখানে মাঝারি আকারের প্রজাতি থেকে তারা ক্রমশ শীর্ষ শিকারিতে পরিণত হয়েছিল।’
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার জীবাশ্মবিদ স্টিভ ব্রুসাটের মতে, ‘এই সময়কার জীবাশ্ম খুবই কম। এটি অনেকটা পারিবারিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক বিয়ের ঘটনা জানা না থাকার মতোই কষ্টকর। খানখুলুর সন্ধানে সেই শূন্যস্থান কিছুটা হলেও পূরণ হলো।’
মিউজিয়ামের পুরনো ড্রয়ারেই লুকিয়ে ছিল ইতিহাসের ধ্বনি
ক্যারথেজ কলেজের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক থমাস কার বলেন, ‘এমন অনেক পুরনো জীবাশ্ম রয়েছে যেগুলো দ্বিতীয়বার দেখা হলে অবিশ্বাস্য সব তথ্য বের হয়ে আসে।’
ব্রুসাটে বলেন, ‘আমরা জানতাম এই জীবাশ্মগুলো রয়েছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল কখন সেগুলো নতুন ও চমকপ্রদ তথ্য দেবে।’
এই গবেষণা শুধু টি. রেক্স-এর জন্ম ইতিহাস নতুন করে লেখেনি, বরং এটি আমাদের দেখিয়েছে যে একসময়ে মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে ছোট্ট এক ড্রাগন প্রিন্সের পদচিহ্নেই সূচনা হয়েছিল ভয়ংকর এক রাজবংশের—টাইরানোসরের রাজত্ব।
সূত্র: সিএনএন।
রাকিব