ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

AI দিয়ে ছবি বানানো জনপ্রিয় হলেও গোপনীয়তা কোথায় হারাচ্ছে?

প্রকাশিত: ১২:১১, ৩০ জুলাই ২০২৫

AI দিয়ে ছবি বানানো জনপ্রিয় হলেও গোপনীয়তা কোথায় হারাচ্ছে?

ছ‌বি: প্রতীকী

আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI দিয়ে ছবি তৈরি করা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ নিজের ছবি কার্টুন করে, কেউ নিজের ভবিষ্যতের রূপ কেমন হবে তা জানতে চায়, আবার কেউ পুরোনো ছবিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে AI-এর সাহায্যে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। কিন্তু এর পেছনে কিছু ভয়ঙ্কর দিকও লুকিয়ে আছে, যেগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া খুব জরুরি। বিশেষ করে গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির বিষয়টি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমত, অনেকেই জানেন না, AI দিয়ে ছবি তৈরি করতে হলে সেই ছবিগুলো কোনো না কোনো অ্যাপে আপলোড করতে হয়। এই অ্যাপগুলো অনেক সময় ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ছবি, নাম, লোকেশন, এমনকি ফোনের গ্যালারির অ্যাক্সেসও চেয়ে নেয়। ব্যবহারকারী কিছু না ভেবেই "Allow" করে দেয়, কিন্তু বুঝতে পারে না এই তথ্যগুলো কিভাবে, কোথায় বা কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। একবার যে ছবি বা তথ্য ইন্টারনেটে চলে যায়, তা আর পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না।

দ্বিতীয়ত, এই ধরনের AI অ্যাপ বা ওয়েবসাইট অনেক সময় ব্যবহারকারীর ছবি ডেটাবেইসে জমা রাখে এবং সেটিকে আবার অন্য কাজে ব্যবহার করে। ধরুন, আপনি আপনার একটি সাধারণ ছবি দিয়ে AI আর্ট বানিয়েছেন। সেই ছবি হয়তো কোনো কোম্পানি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে ফেলল, অথচ আপনি জানলেনই না। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আপনার চেহারার আদলে Deepfake ভিডিওও তৈরি হতে পারে, যা ভয়ানক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

তৃতীয়ত, AI দিয়ে বানানো ছবি অনেক সময় এমন হয় যে বোঝা যায় না আসল আর নকল কোনটা। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার চেহারা ব্যবহার করে অশ্লীল বা আপত্তিকর কনটেন্ট তৈরি করে, তাহলে সেটা আপনার সম্মানহানি ঘটাতে পারে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, যেখানে অভিনেত্রী বা সাধারণ নারীর মুখ বসিয়ে পর্নো ভিডিও বানিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী তখন বিচার চাইলেও, সেই ছবি বা ভিডিও একবার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে তা পুরোপুরি সরানো প্রায় অসম্ভব।

চতুর্থত, অনেক AI টুল এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা শুধু ছবি থেকেই একজন মানুষের বয়স, লিঙ্গ, মনের অবস্থা বা রুচি বোঝার চেষ্টা করে। এই তথ্যগুলো কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করে, আবার কিছু হ্যাকার বা অসাধু ব্যক্তি চুরি করে নানা ধরণের প্রতারণায় ব্যবহার করতে পারে। অনেক সময় এসব তথ্য দিয়ে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিন্ডারে প্রতারণা করা হয়।

পঞ্চমত, অনেক দেশেই এখনো AI প্রযুক্তির ওপর কোনও সুনির্দিষ্ট আইন নেই। ফলে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আইন না থাকলে কেউ যদি আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার ছবি দিয়ে কিছু করে ফেলে, আপনি কোথায় অভিযোগ করবেন বা কীভাবে বিচার পাবেন তা অনেক সময় পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তির প্রসার বাড়লেও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং আইনগত কাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি।

তবে সব দোষ শুধুই প্রযুক্তির নয়। ব্যবহারকারীর সচেতনতাও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। অনেক সময় মানুষ নিজেই নিজের ব্যক্তিগত ছবি, তথ্য ইচ্ছা করে আপলোড করে বা শেয়ার করে দেয় বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। ছবি তৈরি করতে গিয়ে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন না পড়ে "Agree" করে দেয়। পরে যখন কোনো বিপদ ঘটে, তখন বুঝতে পারে ভুলটা কোথায় হয়েছে।

তাই, AI দিয়ে ছবি বানানোর মজাটা উপভোগ করার পাশাপাশি আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কোন অ্যাপ ব্যবহার করছি, তারা কী ধরনের অনুমতি চাইছে, আমাদের ছবি তারা কোথায় সংরক্ষণ করছে—এসব বিষয়ে জানা ও বোঝা দরকার। প্রয়োজনে ছবিতে নিজের মুখ কম দেখানো, মুখ ঝাপসা করে দেওয়া বা ওয়াটারমার্ক ব্যবহার করাও নিরাপদ হতে পারে।

AI দিয়ে ছবি বানানো নিঃসন্দেহে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যা শিল্প, বিনোদন ও প্রযুক্তিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। তবে এর অন্ধ ব্যবহার আমাদের গোপনীয়তা হরণ করছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামাজিক ও মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই আনন্দের পাশাপাশি সতর্কতা জরুরি—এটাই সময়ের দাবি।

এম.কে.

×