
আমরা এখন বর্ষাকালের আষাঢ় মাস অতিক্রমের ধারায় বৃষ্টি বাদলকেও সামলাতে ব্যস্ত। ছয় ঋতুর অভাবনীয় পালাক্রমে আবহমান বাংলা এখনো অনিন্দ্য সুন্দর বরেন্দ্র অঞ্চল। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন- বীজ মাত্রই নাকি এখানে সোনা ফলে। তাই তো যুগ-যুগান্তরের উর্বর পলিমাটির শ্যামল বাংলা শুধু স্বদেশি কবি- সাহিত্যিকদেরই নয় বরং ভিনদেশি পরিব্রাজকদেরও দৃষ্টি কেড়েছে। চতুর্দশ শতকের তিউনিসিয়ার আরব মনীষী ইবনে বতুতা চিরায়ত বাংলার রূপশৌর্যে বিমুগ্ধতার যে চিত্র আঁকেন তাও এই অঞ্চলের পরম বরমাল্য। আর সপ্তদশ শতকের ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার এমন উপলব্ধি করেছিলেন শাশ্বত বাংলার অনন্য নৈসর্গিক সম্ভারের তা আজও এক অনন্য সত্য কথন। তিনি বলেছিলেন সৌন্দর্যের রানী বাংলায় প্রবেশের বহু পথ নির্দেশিত থাকলেও বেরুনোর পথ খুঁজতে হিমশিম খেতে হয়। সত্যিই শ্যামল বাংলার নানামাত্রিক নৈসর্গিক শোভা যে মাত্রায় সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে পূর্ণ করে রেখেছে সেটা যেন পরম করুণাময়ের অবারিত আশীর্বচন। নদী-স্নাত আর সমুদ্র পরিবেষ্টিত চিরায়ত বাংলা আবার ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা বৈষয়িক সম্পদেরও লীলা ক্ষেত্র। তার পরেও সৌন্দর্যমণ্ডিত উর্বর পলিমাটির দেশ বঙ্গভূমির বিপদ-বিপত্তিরও যেন শেষ-পরিশেষ ছিল না। আমরা এখন যে বর্ষণ ধারায় পরিবেশকে আলিঙ্গন করছি সেখানে হিত-বিপরীতের দ্বৈত চক্রের নৈসর্গিক বাতাবরণ জনগোষ্ঠীর জীবন লড়াইয়ের বিপরীত প্রদাহ। উপকূলীয় অঞ্চল এই দেশের সংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবনগাঁথাও স্বস্তিদায়ক কিংবা সুখকর হয়ই না। জীবন সংগ্রামের নিয়ত যাতনাও কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। উর্বর ভূমিতে বর্ষকাল মানেই অধিক বৃক্ষ রোপণের পরম সুসময়। যেখানে সারা বছর গাছ কাটার যে ধুম পড়ে তাও শ্যামল বাংলাকে নয়-ছয় করে দিচ্ছে বলে প্রকৃতি বিশারদরা হুঁশিয়ারি দিতে কার্পণ্যই করছেন না। আর আধুনিক উন্নয়ন যাত্রায় নৈসর্গের ওপর যে অহেতুক, অযাচিত আক্রমণ সেটা বর্তমানে আর আড়ালে আবডালে নেই। শুধু কি বৃক্ষ নিধন? পাশাপাশি বন-বনান্তর উজাড় করে শ্যামল প্রকৃতির যে দৈন্যদশা তাও কোলের সন্তানদের হরেক দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে বলে নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। তাই শুধু নিধনযজ্ঞ নয় নতুন সৃষ্টির অদম্য প্রেরণায় আরও গাছ লাগানোকে কিছুটা প্রতিকার তো মনে করছেনই। শুধু কি গাছ কাটা আর বন-বনান্তর শেষ করে দেওয়া? তার চেয়ে বেশি কোলের সন্তানের নিত্য জীবনকে বহুমুখী হুমকির আবর্তে ঠেলে দেওয়া, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এমন কি প্রতিকার-প্রতিরোধও সেভাবে দৃশ্যমান না হওয়া আর এক সমস্যা শঙ্কুল রাস্তা তো অবশ্যই। ছোট্ট বাংলাদেশ ১৮ কোটি জনসংখ্যার জায়গা সঙ্কুুলানও অত সহজসাধ্য নয়। জনসংখ্যাবিদ ম্যালথাস তথ্য-উপাত্ত এবং জ্ঞান গর্ভ আলোচনায় নির্দেশনা দেন- সম্পদ বাড়ে গাণিতিক হারে আর জনসংখ্যা চলমান প্রক্রিয়ায় জ্যামিতিক হারকেই আলিঙ্গন করে। কারণ ভূমি সীমাবদ্ধই শুধু নয়। পাশাপাশি ভূমি হরেক বনদস্যুদের নির্বিচার আস্ফালনে ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাওয়াও পরিস্থিতির বিপরীত প্রদাহ। অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমি, গাছ আর বন-বনান্তরে যে উন্মত্ত কর্তন তাতে নতুন করে প্রকৃতিকে তার যথাস্থানে নিয়ে আসাও পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার সাহসিক প্রক্রিয়া। বর্ষাকালে উর্বর পলিমাটি আরও ফলনযোগ্য হয় বলে জ্ঞানী-গুণী বিশেষজ্ঞদের ধারণায় উঠে আসে। আবার অবিশ্রান্ত বারিধারায় সফলি খেত থেকে বসতভিটা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার নির্মম পরিস্থিতিও ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্দমনীয় কঠিন পালাক্রম। যার অনধিগম্য উল্টো রথ সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের ওপর যে ছোবল হানে তাও এই অঞ্চলের প্রকৃতির বৈরিতা তো বটেই। সেখানে আরও গাছ লাগানোর সময় হিসেবে নির্ধারণ করা হচ্ছে বর্ষাকালকেই। কিন্তু খালি, পতিত জমি কতখানি অবশিষ্ট থাকে সেটাও চরম বিপন্নতায় অতি সাধারণ মানুষদের জীবন সংগ্রামের ভিন্নমাত্রার দুর্যোগই বলা হয়। তার ওপর আছে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি সব যেন মিলেমিশে একাকার। যা প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানদের ওপর যেন নৈসর্গের চরম প্রতিশোধ।
সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের নেতিবাচক আঁচড়ে যে অনিয়ন্ত্রিত নৈসর্গ সেটাও দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলজনক হয়ইনি। প্রকৃতির যে অবারিত দানে শস্য শ্যামল আবহমান বাংলা সবুজের সমারোহ তেমনি নৈসর্গ যখন ভাঙনের খেলা শুরু করে তাও জনজীবনের চরম বৈরিতা বিপরীত প্রদাহ।
সেখানে ভাবা দরকার কি মাত্রায় প্রকৃতিকে আবার আগের চেহারা ফিরিয়ে আনা কতখানি জরুরি। সেখানে বলা হচ্ছে অধিক বৃক্ষ্ম রোপণ প্রকৃতিকে সুরম্য সবুজের আভরণে শুধু ঢেকে দেবেই নয় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরিতেও নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে। আমরা জানি গাছ বাতাস থেকে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিজের শিকড়ে টেনে নেয়। বিপরীতে নিঃসৃত অক্সিজেন বাতাসে ছেড়ে দেয়। যা নাকি প্রকৃতির সুষম আবহ তৈরিতে যুগান্তকারী অবদান রাখে। আবার শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়গুলোতে যন্ত্রের যে কার্বন নিঃসরণ তা শুধু বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের ওপর বিপরীত প্রদাহ তৈরিই করছে না বরং বিষময় এক বাতাসে সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করতেও পিছপা হয় না। সেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সমসংখ্যক নারী আর কোমলমতি শিশুরাই।
যে কোনো দুর্যোগ, দুর্ভোগ সবার আগে বিপরীত প্রদাহে নাকাল অবস্থায় পড়ে নারী ও শিশুরা। যা সমাজ কিংবা মানুষ দ্বারাই সংঘটিত হোক নয়তো প্রাকৃতিক সংহারের বিপরীত প্রতিক্রিয়াই হোক না কেন। আর নারীরা যদি দূষণ প্রক্রিয়ায় বিপন্ন অবস্থার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছায় সেখানে কোলের সন্তানও নিরাপদ-নির্বিঘ্নে থাকেই না। চার পাশের পরিবেশ যখন বিপন্নতার আকালে পড়ে তখন নাকি নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিরাপদ নিষ্কণ্টক থাকে না। সেখানে উপকূলীয় নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। লোনা পানিতে মৎস্যজীবী নারীরা মাছ ধরতে গিয়ে যে মাত্রায় শারীরিক বিপন্নতার শিকার হচ্ছে হরেক তথ্য প্রতিবেদনে তা ন্যক্কারজনকভাবে উঠে আসছে। পারিপার্শ্বিক বিপরীত প্রদাহ যদি নারী স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্তায় তা হলে আগামীর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্ম বেড়ে ওঠা আর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে? নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা বারবার সাবধান বাণী দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষতিকারক যন্ত্র সভ্যতার লাগাম টেনে ধরতে। তার চেয়েও বেশি প্রকৃতি সহায়ক আধুনিক শিল্প প্রযুক্তির নব উদ্ভাবন। সঙ্গে প্রয়োজনে অধিক বৃক্ষ রোপণ জীর্ণশীর্ণ প্রকৃতিকে নতুন মাত্রা টিকে থাকার অনন্য প্রেরণা হবে। কাজটা খুব কঠিন নয়। শুধু সুনির্দিষ্ট ফসলি খেত কেন? বসত বাড়ির ছাদে, চার পাশের আঙিনায় ফল-ফুলের বীজ রোপণ করে প্রতিটি ঘরেই শ্যামল প্রান্তর নতুন করে তৈরি করা যায় তাও দূষণ প্রকৃতিকে ঠেকানোর রাস্তা হিসেবে ভাবাই যায়। বিভিন্ন বহুতল ভবনের ছাদে, চার পাশে নির্দিষ্ট পরিবারের আঙিনায় ফল-ফুলের আভরণে ঢেকে দিতে পারলে আগামীর প্রজন্ম শ্বাস-প্রশ্বাসে নির্মম বায়ু গ্রহণের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ উপহার পাওয়াও সময়ের অনিবার্যতা। তাই দেরি নয়- সময় থাকতে আরও গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান।
প্যানেল/মো.