ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

আয়ারল্যান্ডে চার্চ-চালিত হোমে ৮০০ শিশুর গণকবর!

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৬ জুলাই ২০২৫

আয়ারল্যান্ডে চার্চ-চালিত হোমে ৮০০ শিশুর গণকবর!

ছবি: সংগৃহীত

আয়ারল্যান্ডের টুয়াম শহরে একটি প্রাক্তন চার্চ-চালিত মা ও শিশু হোমে প্রায় ৮০০ শিশুর মরদেহ গণকবরের প্রমাণ মিলেছে। এটি প্রথম আবিষ্কার করেন স্থানীয় ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলেস। তার গবেষণায় ২০১৬ সালে প্রাথমিক খননে “ব্যাপক পরিমাণে মানব দেহাবশেষ” পাওয়া যায়।

বর্তমানে স্ট ম্যারি’স নামে পরিচিত ঐ হোমটির জায়গায় খনন কাজ শুরু করেছে আয়ারল্যান্ডের অফিস অফ দ্য ডিরেক্টর অফ অথোরাইজড ইন্টারভেনশন (ODAIT)। কানাডা, যুক্তরাজ্য, স্পেন, কলম্বিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ দল এতে অংশ নিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড্যানিয়েল ম্যাকসুইনি জানান, এই কাজ অত্যন্ত জটিল, কারণ অনেক মরদেহ মিশে গেছে, যথাযথ রেকর্ড নেই এবং ডিএনএ ছাড়া ছেলে-মেয়েদের আলাদা করা কঠিন।

এই হোমগুলো মূলত অবিবাহিত, সমাজচ্যুত গর্ভবতী নারীদের জন্য তৈরি হয়েছিল। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ, এগুলোর দেখভাল করত। সেখানে নারীদের ওপর নির্যাতন, শিশুকে জোর করে দত্তক দেওয়া এবং অমানবিক জীবনযাপনের অভিযোগ রয়েছে।

স্ট ম্যারিজ হোমটি ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। হাজার হাজার মা এবং শিশুর পাশাপাশি কিছু পরিবারেরও আশ্রয়স্থল ছিল এটি।

টুয়াম শহরের স্থানীয় ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলেস ২০১২ সালে একটি ঐতিহাসিক প্রকাশনার জন্য গবেষণা শুরু করেন। তখনই তাঁর মনোযোগ যায় শহরের এক পুরনো চার্চ-চালিত "মা ও শিশু হোম"–এর দিকে, যেটি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে আলোচনার বাইরে ছিল। শৈশবে তিনি এই হোমের শিশুদেরকে স্কুলে দেখতেন—অত্যন্ত দুর্বল, চুপচাপ এবং সমাজের বাকি শিশুদের থেকে আলাদা। তাঁরা কখনো উচ্চ শ্রেণিতে উঠতেন না এবং একসময় হারিয়ে যেতেন। সেসময় শিক্ষকরা তাঁদের থেকে দূরে থাকতে বলতেন, কারণ বলা হতো ওরা নাকি রোগ বহন করে।

এই স্মৃতি মনে রেখেই করলেস খুঁজতে শুরু করেন পুরনো রেকর্ড, মানচিত্র এবং স্থানীয় প্রবীণদের স্মৃতি। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পান, ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে হোমটিতে ৭৯৬টি শিশু মারা গেলেও, তাদের কোনো কবর বা মৃত্যুর সরকারি নথি নেই। অথচ সব শিশুর জন্ম ও ধর্মীয় দীক্ষার (baptism) রেকর্ড ঠিকমতো সংরক্ষিত ছিল। তিনি মনে করেন, নিশ্চয়ই এদের গোপনে কোথাও দাফন করা হয়েছে।

তখন করলেস আবিষ্কার করেন ১৯৭০ সালে দুই কিশোর হোমটির পুরনো অংশে খেলা করার সময় একটি পুরনো সেপটিক ট্যাংকের ভেতর হাড়গোড় দেখতে পায়। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে আলোচিত হলেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। তখন বলা হয়েছিল, এগুলো হয়তো ১৮৪০-এর দশকের দুর্ভিক্ষে মৃতদের কঙ্কাল।

কিন্তু করলেসের গবেষণায় প্রমাণ মেলে যে সেই সেপটিক ট্যাংকটি প্রকৃতপক্ষে শিশুদের গণকবর হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছিল। এই আবিষ্কারের পর চার্চ প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করে এবং এমনকি একটি পিআর কোম্পানি ভাড়া করে গণমাধ্যমে তথ্য বিকৃত করার চেষ্টা করে। তারা দাবি করে হাড়গোড় দুর্ভিক্ষের সময়কার।

তবে করলেস তাঁর সমস্ত দলিল, তথ্য ও সাক্ষ্য নিয়ে জনসমক্ষে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে আয়ারল্যান্ড সরকার বিষয়টি তদন্তে নামতে বাধ্য হয়। এই একক নারীর অধ্যবসায়ই একটি গোপন গণকবরের ভয়াল সত্য উন্মোচন করে, যা বহু বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নীরবতায়।

সরকারি মৃত্যু সনদে দেখা গেছে, যেসব কারণে শিশুরা মারা গেছে তার মধ্যে রয়েছে: যক্ষ্মা, খিঁচুনি, অ্যানিমিয়া, মেনিনজাইটিস, হুপিং কাশি ও নানা সংক্রমণ।

হোমটিতে গরম পানি, কেন্দ্রীয় গরম ব্যবস্থা, বা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কোনো কিছুই ছিল না।

২০১৪ সালে তৎকালীন আর্চবিশপ মাইকেল নীয়ারি হতবাক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “এত শিশু মৃত্যু ভয়াবহ এবং দুঃখজনক।”

২০২১ সালে ক্যাথলিক চার্চের আর্চবিশপ ইমন মার্টিন বলেন, চার্চ এমন এক সংস্কৃতির অংশ ছিল যেখানে মানুষকে কলঙ্কিত করা হতো। তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করে বলেন, “আমি নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

২০২১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিচেল মার্টিন সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চান। ছয় বছরব্যাপী তদন্ত শেষে সরকার একটি ৩,০০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশ করে এবং খননকাজ অনুমোদন করে। ২০২২ সালে আইন করে দেহাবশেষ উত্তোলন ও পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়।

মুমু ২

×