
শারদীয় দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠানের ভিত্তি ভারতীয় ক্ল্যাসিক পুরাণ
দেবী দুর্গা ও তার সন্তানদের রূপ আর্যের। কোল ভিল সাঁওতালদের দেশে আর্য মায়ের এত প্রভাব কি করে হলো সে এক রহস্য। সে কি সুদূর অতীতের উৎসকে জাগ্রত রাখার জন্য? যদিও ধর্মীয় ব্যাখ্যা অন্য রকম এবং বাংলা অঞ্চল ছাড়া দুর্গা অন্য কোথাও এত আড়ম্বরে পূজিত হন না। ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে মূল উৎসব দুর্গাপূজা নয়, দেয়ালি বা দীপাবলী, কোনো কোনো রাজ্যে দুর্গার সন্তানরা আলাদাভাবে মর্যাদা পান। মহারাষ্ট্রে গণেশ সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। লক্ষ্মী সরস্বতীর ভক্তও প্রচুর। মগধ উৎকল আর উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা গৌড় রাজ্যের পরাক্রমশালী রাজা শশাঙ্ক ছিলেন লক্ষ্মীর ভক্ত। অবশ্য তার মূল উপাস্য ছিলেন শিব। দুর্গার স্বামী। তার আমলে চালু মুদ্রার এক পিঠে ছিল শিবের মূর্তি অন্য পিঠে লক্ষ্মীর। সেও সেই ছয় শ’ খ্রিস্টাব্দের কথা। অত আগে থেকে দুর্গা পরিবারের সদস্যদের পূজা হয়ে এলেও একমাত্র বাঙালির কল্পনায়ই তিনি পুত্র-কন্যা সিংহ বাহিনীসহ পূর্ণরূপে ধরা দিয়েছেন
শারদীয় দুর্গাপূজার আচার-অনুষ্ঠানের ভিত্তি ভারতীয় ক্ল্যাসিক পুরাণ। দেবতাদের বিচরণ এলাকা স্বর্গরাজ্যে এক সময় হানা দেয় অশুভ শক্তি অসুর। তার তা-বে দেবতারা পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। অনেকে তাকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। অসুর দম্ভ করে বলে, ‘কোনো পুরুষ আমাকে হত্যা করতে পারবে না।’ এক সময় তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে এ বর দিয়েছিলেন। বর পেয়ে ধীরে ধীরে অসুরের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। ব্রহ্মা বিব্রত হন। নিজের দেওয়া বর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অন্য দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ঠিক করলেন নারী শক্তি দিয়ে অসুর দমন করবেন। যেহেতু তিনি নিজেই বলেছিলেন, অসুরকে কোনো পুরুষ হত্যা করতে পারবে না তাই নারীরূপে দুর্গাকে অসুর দমনে পাঠান। আশ্বিন মাসের শুল্কা দশমীতে মহিষাসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি এ পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলে। শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন রাজা রামচন্দ্রের সময় থেকে। রাবণের কাছে বন্দী সীতাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে রাম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তখন ছিল শরৎকাল। শরৎ থেকে শারদীয়।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা যা-ই থাক কোথায় যেন এ উৎসব ধর্মকে ছাপিয়ে যায়। যেন প্রকৃতির উৎসব, ঋতু মেনে তিথি গুনে আয়োজন। কৃষিনির্ভর বাংলার দিনপঞ্জি চলত গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাবে। কৃষকের আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হয় ঋতুকে কেন্দ্র করে। বারো মাসে তেরো পার্বণের যে প্রবাদ তারও ভিত্তি ওই ঋতু। ফসল বোনার, ফসল কাটার, নবান্ন, সংক্রান্তি ইত্যাদি নানা উপলক্ষে উৎসবের ছলে এক হওয়া। ধর্মের আবরণটুকু সরিয়ে দিলে ভীষণই প্রাকৃতিক। শাব্দিক অর্থেই সর্বজনীন। বাঙালিয়ানার সবটুকু ধারণ করে আছে এ উৎসব।
নিজের সন্তানদের নিয়ে দেবী দুর্গার যে রূপ তা যেন আদিম যূথবদ্ধ সমাজে মায়েরই অন্যরূপ। বনের ফলমূল সংগ্রহ থেকে শিকার করে জীবন ধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ে মা-ই আগলে রাখতেন পুরো পরিবার। তার নেতৃত্বে চলত সে সময়ের ছোট পরিসরের সমাজ। সমাজ বলতে পরিবারই আসলে। একজন মা ও তার ছেলেমেয়ে নিয়ে ছিল এর বিস্তৃতি।
দেবী দুর্গা ও তার সন্তানদের রূপ আর্যের। কোল ভিল সাঁওতালদের দেশে আর্য মায়ের এত প্রভাব কি করে হলো সে এক রহস্য। সে কি সুদূর অতীতের উৎসকে জাগ্রত রাখার জন্য? যদিও ধর্মীয় ব্যাখ্যা অন্য রকম এবং বাংলা অঞ্চল ছাড়া দুর্গা অন্য কোথাও এত আড়ম্বরে পূজিত হন না। ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে মূল উৎসব দুর্গাপূজা নয়, দেয়ালি বা দীপাবলী, কোনো কোনো রাজ্যে দুর্গার সন্তানরা আলাদাভাবে মর্যাদা পান। মহারাষ্ট্রে গণেশ সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। লক্ষ্মী সরস্বতীর ভক্তও প্রচুর। মগধ উৎকল আর উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা গৌড় রাজ্যের পরাক্রমশালী রাজা শশাঙ্ক ছিলেন লক্ষ্মীর ভক্ত। অবশ্য তার মূল উপাস্য ছিলেন শিব। দুর্গার স্বামী। তার আমলে চালু মুদ্রার এক পিঠে ছিল শিবের মূর্তি অন্য পিঠে লক্ষ্মীর। সেও সেই ছয় শ’ খ্রিস্টাব্দের কথা। অত আগে থেকে দুর্গা পরিবারের সদস্যদের পূজা হয়ে এলেও একমাত্র বাঙালির কল্পনায়ই তিনি পুত্র-কন্যা সিংহ বাহিনীসহ পূর্ণরূপে ধরা দিয়েছেন।
আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে আসেন তিনি। তখন শরৎকাল। শরতের আকাশ মোটেই ‘মন কেমন করা’ নয়, বরং উজ্জ্বল নীলাকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ঠিকরানো আলো মনকে নাচিয়ে দেয়। কৈশোরের নির্ভার আনন্দে ভেসে যাওয়া যেন- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে...।’ এই আকাশ এই প্রকৃতি দেখতে পান যারা, যারা শুনতে পান এই সুর শারদ উৎসব তাদের। সেখানে ধর্মের গ-ি নেই। আছে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ আর একে অন্যকে ছুঁয়ে যাওয়া। ছন্নছাড়া স্বামী শিব, তিনি শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান। সারা বছর তাকে আগলে রেখে শরতে হিমালয়ের কৈলাস থেকে নেমে আসেন উমা। এই শ্যামল প্রকৃতির বাংলা তার বাপের বাড়ি। সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন তিনি। ঢাক-শঙ্খ ধান-দূর্বায় উৎসবে মাতান বাপের বাড়ির সবাইকে। কী দারুন কল্প চিত্র! শারদ উৎসবের লৌকিক দিক বড় বেশি জীবনঘেঁষা। চেনা জীবনের গল্পই যেন বলে সে। আর অতি লৌকিক দিক সমৃদ্ধ করেছে পুরাণ সাহিত্য।
সে যুগে পৌরাণিক সাহিত্যের এত সমৃদ্ধি কি করে হয়েছিল সেও এক বিস্ময়। পৃথিবীর পুরাণ সাহিত্যে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে গ্রিক পুরাণের। বিস্তৃতি ও ব্যাপকতায় তা গ্রিক পুরাণকে ছাপিয়ে গেছে। এক ক্ল্যাসিক পুরাণ থেকে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য অনু পুরাণ। তাকে আশ্রয় করে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য।
এসব কাহিনীর লৌকিক-পারলৌকিক দু’রকম পাঠই আছে। পারলৌকিক পাঠ বেঁচে আছে ধর্মবিশ্বাসে আর লৌকিক পাঠ সাহিত্যের সম্পদ। গ্রিক পুরাণ থেকে ভারতীয় পুরাণ সম্ভবত এখানেই আলাদা। গ্রিক পুরাণের চরিত্ররা সাহিত্যেই বিচরণ করে। ভারতীয় পুরাণ চরিত্ররা শুধু সাহিত্যে নয়, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে নিয়ত উদযাপিত।
সনাতন ধর্ম মানুষের লৌকিক জীবনকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে এগোতে এগোতে অনেক কিছু আত্মস্থ করেছে। তবে ধর্মীয় নিয়মনিষ্ঠার কড়াকড়ি, বিশেষ করে বর্ণপ্রথা, একে সঙ্কীর্ণও করেছে। গোঁড়ামি সব ধর্মকেই সঙ্কীর্ণ করে, যার অনিবার্য পরিণতি হিংসা আর সন্ত্রাস। তার ওপর রয়েছে এর রাজনৈতিক ব্যবহার। ধর্মকে যখন থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছে তখন থেকে এতে গোঁড়ামি ও সন্ত্রাস ঢুকেছে।
মনকে মুক্ত রাখা তাই জরুরি। শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি মানুষকে সত্যিকারের মানুষের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। শুধু ধর্মের পরিচয়ে কাউকে আবদ্ধ রাখা সঙ্কীর্ণতার প্রকাশ। মানুষের পরিচয় তার কাজে, আচরণে। দুটো ভাগ থাকতে পারে সেখানে। ভালো মানুষ, খারাপ মানুষ। ভালো মানুষ তিনি যে ধর্মেরই হোন, ভালোই। খারাপও তেমনি। যে ধর্মের হোক, খারাপই। ধর্ম বিশ্বাসের পূর্ব নির্ধারিত ধারণা মানুষ বিচারের মানদণ্ড হতে পারে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিন্যাসে এ বিষয়টি যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন পারিবারিক পরিম-লেও।