
ছবি: প্রতীকী
সকালে ঘুম ভাঙার পর হঠাৎ বুক ধড়ফড় অনুভব করা অনেকের মাঝেই একধরনের উদ্বেগ তৈরি করে। এটি এমন এক অনুভূতি, যেখানে বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন যেন অস্বাভাবিকভাবে জোরে, দ্রুত বা অনিয়মিত মনে হয়। কেউ কেউ বলেন “হৃদয়টা মুখে এসে পড়ছে”, কেউ বলেন “কাঁপুনি দিচ্ছে বুকের ভেতর।” এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, এটি কি হৃদযন্ত্রের কোনো গোপন বিপদের বার্তা, নাকি ফুসফুসের কোনো সমস্যার ইঙ্গিত? আবার অনেকে ভাবেন এটা কি নিছক উদ্বেগ বা মানসিক চাপের প্রতিফলন?
ঘুম থেকে উঠেই বুক ধড়ফড় করার পেছনে শরীরের নানা শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক কারণ থাকতে পারে। যেহেতু হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুস উভয়ই আমাদের বুকে অবস্থিত এবং একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, তাই একটির সমস্যা অন্যটির লক্ষণ হিসেবে ধরা দিতে পারে। তবে কিছু লক্ষণ ও শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায় সমস্যার মূল উৎস কোথায়।
হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে ঘুম ভাঙার পর বুক ধড়ফড় করা সাধারণত হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার (ট্যাকিকার্ডিয়া), হার্টের অস্বাভাবিক রিদম (এরিদমিয়া) বা হঠাৎ রক্তচাপ ওঠানামার কারণে হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস বা হৃদপিণ্ডের ভালভজনিত রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতা উদ্বেগজনক হতে পারে। কখনো কখনো হৃদপিণ্ড ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে না পারলে শরীর অক্সিজেন ঘাটতির সংকেতে এই ধরণের ধড়ফড় তৈরি করে। রাতে ঘুমের মধ্যে হার্টের গতি ধীর থাকে, কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার সময় sympathetic nervous system সক্রিয় হয়ে হৃদপিণ্ডে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এই হঠাৎ পরিবর্তনের ফলেও বুক ধড়ফড় হতে পারে।
অন্যদিকে, ফুসফুসের সমস্যাও বুক ধড়ফড়ের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যদি ঘুম থেকে উঠে বুকে চাপ অনুভব হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বা দমবন্ধ লাগার মতো অনুভূতি হয়, তাহলে এটি ফুসফুস সংক্রান্ত হতে পারে। যেমন: অ্যাজমা, সিওপিডি, ফুসফুসে সংক্রমণ বা রাতে ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া (স্লিপ অ্যাপনিয়া) এমন অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীরা ঘুমের মধ্যে বারবার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেহে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, যা ব্রেইনের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে ধড়ফড়ের সংকেত পাঠায়। ফলে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে।
তবে শারীরিক সমস্যা ছাড়াও মানসিক অবস্থা এখানে বড় ভূমিকা রাখে। ঘুম থেকে ওঠার পর যাদের অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বা প্যানিক ডিজঅর্ডার রয়েছে, তাদের মাঝেও বুক ধড়ফড় দেখা দেয়। যাদের রুটিনে পর্যাপ্ত ঘুম নেই, রাত জেগে কাজ করেন বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে sympathetic nervous system অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তোলে। মানসিক উদ্বেগে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে বুক ধড়ফড়ের জন্ম দেয়। এটি হয়তো মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়, তারপর নিজে থেকেই কমে যায়। কিন্তু যারা ঘন ঘন এ ধরনের সমস্যা অনুভব করেন, তাদের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাংজাইটি বা প্যানিক ডিজঅর্ডার থাকতে পারে।
আরও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে রক্তে চিনির মাত্রা হঠাৎ করে কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন এবং রাতে ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় হঠাৎ চিনির মাত্রা কমে গিয়ে বুক ধড়ফড়, মাথা ঘোরা, ঘাম হওয়া, ঝিমঝিম ভাব দেখা দিতে পারে।
তবে কোনো অবস্থাতেই এমন ধড়ফড়কে অবহেলা করা উচিত নয়। যদি এই অনুভূতির সঙ্গে বুকে ব্যথা, বাম হাতে অস্বস্তি, ঘাম, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত লক্ষণ থাকে, তাহলে তা জরুরি চিকিৎসা সহায়তা দাবি করে। কারণ এটি হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাসও হতে পারে। বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০-এর ওপরে, ধূমপান করেন, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য এই লক্ষণ আরও গুরুত্বপূর্ণ।
একইভাবে, যদি ধড়ফড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা মনে হয় দম আটকে যাচ্ছে, তবে ফুসফুসের কোনো জটিলতা— যেমন নিউমোনিয়া বা অ্যাজমার অ্যাটাক ঘটছে কিনা, সেটি দেখতে হবে। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের ইতিহাস থাকলে, একজন পালমোনোলজিস্টের (ফুসফুস বিশেষজ্ঞ) পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এছাড়া, যদি ধড়ফড় অল্প সময়ের জন্য হয় এবং মানসিক চাপে বেশি হয়, তবে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি বা প্যানিক ডিজঅর্ডার অনেক সময় শারীরিক লক্ষণের ছদ্মবেশে ধরা দেয়। মানসিক চাপ, ঘুমের ব্যাঘাত, সামাজিক বা পারিবারিক টেনশন এমন উপসর্গ তৈরি করতে পারে।
এই ধরনের সমস্যা প্রতিরোধে কিছু সাধারণ অভ্যাস খুব কার্যকর হতে পারে। যথাযথ ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের অনুশীলন, যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন—সবকিছুই হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং মানসিক প্রশান্তি আনে। ক্যাফেইন ও অ্যালকোহলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, রাতে হালকা খাবার খাওয়া এবং ঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এই সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
সবশেষে বলা যায়, ঘুম থেকে ওঠার সময় বুক ধড়ফড় কোনো সাধারণ ব্যাপারও হতে পারে, আবার ভয়ংকর কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকির ইঙ্গিতও হতে পারে। তাই নিজের শরীরের ভাষা বোঝা, সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধু অনুমান বা ভয় নয়, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সচেতন পর্যবেক্ষণই পারে আপনাকে নিরাপদ রাখতে।
এম.কে.