
.
বাংলাদেশের নারী ফুটবলে এখন যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সবচেয়ে বেশি সম্মানিত এবং প্রেরণাদায়ী; তিনি হলেন ঋতুপর্ণা চাকমা। যিনি শুধু দেশের গি তেই নিজেকে আটকে রাখেননি বরং ছুঁয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের শীর্ষ চূড়া। তার পায়ের জাদু, গোলে চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি এবং নির্ভার খেলোয়াড়সুলভ আচরণ। সব মিলিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন অনুপ্রেরণা। একটা সময় ছিল, যখন নারী ফুটবল মাঠে দর্শক তেমন আসত না, সংবাদমাধ্যমেও তেমন গুরুত্ব পেত না। কিন্তু সময় বদলেছে।
আজ বাংলাদেশ নারী দল সাফ চ্যাম্পিয়ন, এশিয়ান কাপের দ্বারপ্রান্তে। আর এই পালাবদলের অন্যতম প্রধান কুশলী ঋতুপর্ণা চাকমা। তার ভেতরে একাধারে আছে পাহাড়ের মাটির শক্তি, ভালোবাসার বেদনার গভীরতা এবং জয়ী হওয়ার দুর্দমনীয় জেদ।
এই তারকার খেলা দেখে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঋতুপর্ণা বাংলাদেশের মেসি। ওর খেলার ধরন, বল নিয়ে দৌড়, গতি সবকিছুতেই মেসির ছায়া আছে। আমি নিজ চোখে যা দেখেছি, তাতে বলতেই হয়, ও আলাদা একটা মানের খেলোয়াড়।’ এমন প্রশংসা সবার জন্য আসে না। কিন্তু ঋতুপর্ণা যেভাবে টানা ম্যাচে পারফর্ম করে চলেছেন, তাতে তিনি এ উপাধির পুরোপুরি যোগ্য। শুধু বাহ্যিক খেলায় নয়, ভেতরের মানসিক দৃঢ়তা, আত্মত্যাগ আর দায়বদ্ধতাও তাঁকে সত্যিকারের একজন চ্যাম্পিয়নে পরিণত করেছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোতে ঋতুপর্ণা ছিলেন বাংলাদেশের সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দু। প্রথম ম্যাচে বাহরাইনের বিরুদ্ধে তার দুর্দান্ত গোল বাংলাদেশের বড় জয় নিশ্চিত করে দেয় (৭-০)। তবে আরও বড় ইতিহাস তিনি লিখেছেন দ্বিতীয় ম্যাচে। স্বাগতিক মিয়ানমারের বিপক্ষে ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে বাংলাদেশের ২-১ গোলের জয় আসে তার জোড়া গোলে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের (১২৮) চেয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমার (৫৫), তাদের নিজেদের মাঠে হারিয়ে দেওয়া ছিল এক অলীক স্বপ্ন। অথচ সেই স্বপ্নকেই বাস্তব বানিয়ে ঋতুপর্ণা নিজ হাতে লিখেছেন নতুন ইতিহাস।
প্রথম গোলটি আসে ১৮ মিনিটে। ম্যাচ শুরুর আগেই মাহফুজা কিরণ মেয়েদের বলেন, ‘২০ মিনিটের মধ্যে গোল চাই। ওদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে হলে শুরুতেই চমকে দিতে হবে।’ ঋতুপর্ণা যেন সে নির্দেশই মাঠে প্রতিফলিত করেন। দ্বিতীয়ার্ধে তার দ্বিতীয় গোল ছিল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় উপস্থিত থাকার নিখুঁত উদাহরণ। কৌশল, দৃঢ়তা ও নিয়ন্ত্রিত আত্মবিশ্বাস সব মিলিয়ে দুটি গোলই ছিল ক্লাসিক্যাল ফরোয়ার্ডের।
বাংলাদেশের নারী দলের কোচ পিটার বাটলার মিয়ানমার ম্যাচের পর বলেন, ‘ঋতুর দুটা গোলই অসাধারণ। আমি সবসময় বলি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা খেলোয়াড়দের মান বাড়ায়। আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। ম্যাচের আগে হয়ত অনেকে ভাবেনি এমন ফল হবে, কিন্তু আমি জানতাম মেয়েরা পারবে। ঋতু শুধু গোল করেনি, পুরো দলকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।’
ঋতুপর্ণার জীবনের সবচেয়ে গভীর আবেগের জায়গা তার ছোট ভাই পার্বণ, যাকে আদর করে ডাকতেন ‘সিজি’। ২০২২ সালের ২৯ জুন, একটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের দুর্ঘটনায় হঠাৎই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন পার্বণ। ঋতুপর্ণার দুই বছরের ছোট এই ভাই ছিলেন তার সবচেয়ে বড় সমর্থক, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শ্রোতা।
এবারের বাহরাইন ম্যাচের দিন ছিল পার্বণের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ম্যাচে দুর্দান্ত গোল করে ঋতু আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে ভাইকে স্মরণ করেন। পরে ফেসবুকে লেখেন, ‘আজ আমার ছোট ভাইয়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের হয়ে এই গোলটি আমার ভাইকে উৎসর্গ করলাম।’ এ ঘটনাটি কেবল একটি আবেগঘন মুহূর্ত নয়, বরং বুঝিয়ে দেয় ফুটবল শুধুই খেলা নয়, কখনো কখনো তা প্রার্থনার জায়গা হয়ে ওঠে। পার্বণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। প্রতিটি ম্যাচ শেষে পার্বণ ফোন করে বলতেন, ‘দিদি, তুই তো ভাইরাল হয়ে গেছিস!’
তাদের শেষ কথা হয়েছিল ২০২২ সালের ২৮ জুন। পরদিন সকালে বাড়ি ফেরার পথে ঋতুপর্ণা দুঃসংবাদটি পাননি, তাকে জানানো হয়নি। বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন নির্মম সত্য। তখন ক্যাম্প থেকে ছুটি নিয়ে ফিরছিলেন। সেই সময়টিকে আজও ভুলতে পারেন না।
২০১৫ সালে ঋতুপর্ণার বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর মায়ের কাঁধে সংসারের ভার। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ভাই পার্বণই ছিলেন সবচেয়ে কাছের। তার অকালমৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন ঋতু। কিন্তু খেলার মাঠে পা দিলেই যেন পার্বণ তাকে জড়িয়ে ধরেন, বলে ওঠেন ‘তুই পারবি দিদি।’ এই ভরসাই হয়তো ঋতুকে আজকের ঋতুপর্ণা বানিয়েছে। খেলায় তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন, যেন প্রতিটি গোল ভাইয়ের কাছে এক প্রার্থনা।
রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম ঋতুপর্ণার। সেখানে নারী ফুটবলের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ছিল না মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, ছিল না পর্যাপ্ত খেলার মাঠও। কিন্তু দমে যাননি। নিজেকে গড়েছেন নিজ চেষ্টায়। পরিবারের সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেও লড়াই করে খেলার প্রতি ভালোবাসাকে অটুট রেখেছেন। ২০১৭ সালে তিনি জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পান। তারপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতিটি ম্যাচে, প্রতিটি টুর্নামেন্টে ঋতু নিজেকে প্রমাণ করে গেছেন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান কাপ, প্রীতি ম্যাচ যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই আলো ছড়িয়েছেন।
ঋতুপর্ণার খেলায় যা সবচেয়ে চোখে পড়ে, তা হলো আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্ব। তিনি কেবল নিজের খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন না, সতীর্থদের উজ্জীবিত করতেও জানেন। মাঠে তার উপস্থিতি মানেই দলের ভরসা। ম্যাচের চাপে অন্যরা যখন ক্লান্ত, ঋতু তখনো ছুটে চলেন প্রয়োজনে একাই ডিফেন্স চিরে এগিয়ে যান গোলের দিকে। সাফে পাকিস্তানের বিপক্ষে গোল করে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভাইকে কখনো ভুলতে পারি না। মনে হয় এখনো আমার পাশে আছে। ম্যাচে নামার আগে এক জেদ কাজ করে, যেভাবেই হোক গোল পেতে হবে। ভাইকেই উৎসর্গ করতে হবে।’ এই দায়বদ্ধতা, এই মানবিক সংযোগই তাকে আজ ঋতুপর্ণা বানিয়েছে।
আর ঋতুর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ নারী দলকে এশিয়ার চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে গেছে। আগামী বছর মার্চে অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ান কাপের মূল আসর। এই আসরের চূড়ান্ত পর্ব কাজ করবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব হিসেবেও। মেয়েদের এশিয়ান কাপ প্রথম শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রথম ২০ আসরে খেলেছে ২২টি দল। বাংলাদেশ সুযোগ পেল ২৩তম দল হিসেবে। ২০২৬ নারী এশিয়ান কাপে বাংলাদেশসহ এখন পর্যন্ত পাঁচটি দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। স্বাগতিক হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সুযোগ পেয়েছে। ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নারী এশিয়ান কাপের ফলের ভিত্তিতে সুযোগ পেয়েছে তিনটি দেশ। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চীন, রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া ও তৃতীয় হওয়া জাপান সরাসরি সুযোগ পেয়েছে ১২ দলের ২০২৬ এশিয়ান কাপে। বাছাইপর্ব পেরিয়ে সুযোগ পাবে আট গ্রুপের আট চ্যাম্পিয়নরা। সেই আট দলের একটিকে পেয়ে গেছে ২০২৬ এশিয়ান কাপ।
প্যানেল মজি