
এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে জায়গা করে নেয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে দেশবাসীকে।
সম্প্রতি ইয়াঙ্গুনে এএফসি নারী এশিয়া কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনাকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পর নারী ফুটবলে এই অঞ্চলের অন্যতম পরাশক্তি মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের মূল মঞ্চে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এরপর তুর্কমেনিস্তানকে ৭ গোলের বন্যায় ভাসিয়ে উৎসবের পূর্ণতা দেয় আফঈদা খন্দকারের দল। ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও উড়ছে বাংলার বাঘিনীরা।
অধিনায়ক আফঈদাসহ জাতীয় দলের আট ফুটবলারই আছেন এই দলে। ঢাকার বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় উদ্বোধনী ম্যাচে ৯-১ গোলের জয়ের পথে শ্রীলঙ্কাকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে মিশন শুরু করে বাংলাদেশ। হ্যাটট্রিক করেন মোসাম্মাৎ সাগরিকা। চার দলের টুর্নামেন্টে শক্তির বিচারে বাংলাদেশের পরই নেপালের অবস্থান। উত্তাপ ছড়ানো দ্বিতীয় ম্যাচেই সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঘটনাবহুল এক লড়াইয়ে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ে (৯৭তম মিনিট) রেফারির বাঁশি বাঁজার ঠিক আগে তৃষ্ণা রানীর গোলে ৩-২ গোলের নাটকীয় জয়ে সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে মেয়েরা। শুধু বয়স ভিত্তিক নয়, নরী সাফে টানা দুইবারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে ভালো করলে সুযোগ থাকবে বিশ্বকাপে খেলার। আফঈদা-ঋতুপর্ণাদের চোখ জুড়ে এখন সেই স্বপ্ন।
‘আজকে আমরা যে এই পর্যায়ে এসেছি, সেটা দলীয় পরিশ্রমের কারণে। ফুটবল কোনো ব্যক্তিগত খেলা নয়। আমরা বাংলাদেশের মেয়েরা জানি কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হয়। আমাদের প্রতি বিশ্বাস রাখবেন। আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। শুধু এশিয়া নয়, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে (বিশ্বকাপে) নিয়ে যেতে চাই।’ বলছিলেন নারী দলের বড় তারকা ঋতুপর্ণা চাকমা। উল্লেখ্য, আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে এশিয়ান ফুটবলে মেয়েদের শ্রেষ্ঠত্বের আসর এএফসি এশিয়া কাপ।
যেখানে ভালো করলে সুযোগ থাকবে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার। এমন মুহূর্ত অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার মনে রাখবেন আজীবন, ‘আমাদের এই সাফল্য একদিনে আসেনি। খুবই ভালো লাগছে। এই মুহূর্ত কখনো ভোলার মতো নয়। সকলে আমাদের জন্য দোয়া করবেন আমরা যেন আরও ভালো কিছু করতে পারি। শুধু দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া নয়, আমরা যেন বিশ্বমঞ্চে দেশকে আরও অনেক দূর নিয়ে যেতে পারি।’ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ১৬ গোল দিয়েছে মেয়েরা, যার ৫টিই করেছেন বাংলাদেশের মেসি খ্যাত ঋতুপর্ণা।
তাঁর নাম তাই মুখরিত হয়ে পড়েছে সবখানে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর কাছে তিনি বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, ‘প্রথমত খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। আপনারা দুর্দান্ত। আপনাদের খেলা আমি দেখেছি। আমি কিছুদিন আগে, বোধ হয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জয়ের পর আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের মধ্যে ঋতুপর্ণা আমার ফেভারিট। আমি একটু কারেকশন করতে চাই। আপনি আমার কাছে প্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। আপনি যেভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দৌড়াতে হয়...এটা দারুণ।’ বলেন তিনি।
ইতিহাস গড়া সাফল্যের পেছনে মেয়েদের কৃতিত্ব দিলেন কোচ পিটার বাটলার, ‘কঠিন একটা সপ্তাহ ছিল এবং আমি বলব সম্ভবত এটা স্রেফ কঠিন একটা সপ্তাহ ছিল না। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবশেষ ৯-১২ সপ্তাহ আমাদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। গত বছর থেকে যেটা শুরু হয়েছিল, আমাদের ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। টালমাটাল সময় ছিল। তবে এই মেয়েদের ছাড়া আমরা এখানে আসতে পারতাম না। মেয়েরা যা করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ।
টিম স্টাফসহ সবাইকে ধন্যবাদ।’ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে মিয়ানমার ৫৫তম স্থানে, বাংলাদেশ ১২৮ নম্বরে। অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ের ব্যবধান ৭৩ ধাপ। এর আগে এই মাঠেই ২০১৮ সালে অলিম্পিক বাছাইপর্বে ৫-০ গোলে মিয়ানমারের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। তবে সেসব পরিসংখ্যান পেছনে ফেলে আফঈদারা। মিয়ানমার ম্যাচে জোড়া গোলে স্মরণীয় জয়ের কারিগর ঋতুপর্ণার বক্তব্য, ‘প্রথমেই বলব, আমরা বাংলাদেশ থেকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি।
আমরা আমাদের...যার যার পারফরম্যান্স, তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং সে অনুযায়ী ফল পেয়েছি। সমর্থকদের বলব, সমর্থন করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন যেভাবে সমর্থন দিচ্ছেন, আগামীতেও একইভাবে সমর্থন দিয়ে যান।’
এই সফরের ঠিক আগে সাবিনা খাতুনসহ কয়েক সিনিয়র ফুটবলার প্রকাশ্যে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এরপর তাদের অনেককে বাদ দিয়ে তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে এলো ঐতিহাসিক এ সাফল্য। কঠিন সময়ে বাটলারের দৃঢ় মানসিকতা এবং বাফুফেকে তার পাশে থাকার প্রশংসা করেছেন এমিলি। সাবেক এই অধিনায়ক বলেছেন, সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে মেয়েদের এই অর্জন ফুটবলের সার্বিক চিত্র বদলে দিতে পারে। কারণ এশিয়া কাপে ভালো করলে সুযোগ থাকবে বিশ্বকাপে খেলার। এজন্য এখনই পরিকল্পনা সাজাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়া কাপে অংশ নেবে ১২টি দল। স্বাগতিকসহ ইতোমধ্যে চারটি দল পেয়ে গেছে মূল পর্বের টিকিট। বাকি দলগুলো হলো ২০২২ সালে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন চীন, রানার্সআপ দক্ষিণ কোরিয়া ও তৃতীয় স্থান পাওয়া জাপান। মূল মঞ্চে তাদের সঙ্গী হবে বাছাইপর্বের আটটি গ্রুপের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ আটটি দল। বাংলাদেশই যেখানে প্রথম দল হিসেবে তাদের সঙ্গী হয়েছে। ২০২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চূড়ান্ত পর্ব কাজ করবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব হিসেবেও।
মেয়েদের এশিয়ান কাপ প্রথম শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রথম ২০ আসরে খেলেছে ২২টি দল। বাংলাদেশ সুযোগ পেল ২৩তম দল হিসেবে। ২০২৬ নারী এশিয়ান কাপটা ২০২৭ নারী বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবেও কাজ করবে। ২০২৭ সালে নারী বিশ্বকাপ হবে ব্রাজিলে। এশিয়া থেকে সরাসরি ৬টি দল ও আন্তঃমহাদেশীয় প্লে অফ খেলে সুযোগ পেতে পারে আরও দুটি দল। সেমিফাইনালে ওঠা চার দল সরাসরি সুযোগ পাবে বিশ্বকাপে। কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যাওয়া চার দল দুটি প্লে ইন ম্যাচে মুখোমুখি হবে। জয়ী দুই দল পেয়ে যাবে বিশ্বকাপের টিকিট।
হেরে যাওয়া দুই দল যাবে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে অফে। দুরন্ত-দুর্বার আফঈদা, ঋতুপর্ণাদের ঘিরে এবার আরও বড় স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ। আসলাম-এমিলদের পরামর্শ সিরিয়াসলি পরিকল্পনাটা নিতে হবে এখন থেকেই। ‘আপনারা দুটি কাজ করেছেন আপনারা ইতিহাস নতুন করে লিখছেন, এবং সমাজের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনের যাত্রাকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এজন্যই আমরা আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা নারী দলের পেছনে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।
আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের পেছনে আমরা আছি।’-প্রথমবারের মতো এএফসি এশিয়া কাপের মূল মঞ্চে জায়গা করে নেওয়া নারী ফুটবল দলকে জাঁকালো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলছিলেন তাবিথ আউয়াল। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতির বক্তব্য খুবই প্রেরণাদায়ী। কিন্তু কথায় আছে, খালি মুখে কি আর চিরা ভেজে! ঐতিহাসিক এই অর্জনে যুব ও ক্রিড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরদিন বাফুফে ভবনে উপদেষ্টা এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফুটবলারদের সেই অর্থ প্রদান করে। যুব ও ক্রিড়া উপদেষ্টা এশিয়া কাপ নিশ্চিত করার পর অর্ধ কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করলেন। বাফুফে হাতিরঝিলে গভীর রাতে সংবর্ধনা দিলেও সেখান থেকে আর্থিক কোনো পুরস্কারের ঘোষণা আসেনি। নতুন পুরস্কার ঘোষণা তো দূরের কথা, সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ঘোষিত দেড় কোটি টাকা এখনো পর্যন্ত দিতে পারেননি কর্তারা।
সংবর্ধনার মঞ্চে মেয়েদের স্তুতি আর স্বপ্নের কথা বলেছেন তাবিথ,‘নারী ফুটবল দলের কারণে আজ সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে নতুন আলোয় দেখছে। আমরা আর কেবল বন্যা ও দুর্যোগের দেশ নইÑআমরা এখন ফুটবলের দেশ। আমরা নারী সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের দেশ। আমরা আর পিছনে ফিরে যাব না, নারীদেরও পেছনে পড়ে থাকতে দেব না।’ এগিয়ে চলার পথে ঋতুপর্ণা, মনিকা চাকমাদের প্রতি অটুট সমর্থনের বার্তা দেন বাফুফে সভাপতি,‘১৮ কোটি মানুষ আপনাদের পাশে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি। আমরা অঙ্গীকার করছি আপনাদের সঙ্গে থাকার। আপনারা এগিয়ে যান, পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই।’ তাবিথ জানান বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্পষ্ট, ‘আপনাদের জন্য আমাদের থাকবে সব রকম প্রার্থনা, অভিজ্ঞতা আর সহায়তা। এই যাত্রা থেমে যাওয়ার নয়। এখন আমাদের একটি অঙ্গীকার, একটি স্লোগান, একটি ট্যাগলাইনÑমিশন অস্ট্রেলিয়া।’