ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের প্রত্যাশা

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১৭:৪৩, ৯ জুলাই ২০২৫

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের প্রত্যাশা

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। একটি স্থিতিশীল এবং নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সঠিকভাবে চলতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকে, তখন ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, বিনিয়োগ বাড়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিনিয়োগ কমে যায় এবং অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অর্থনীতির চালিকা শক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যকে পেছনে রেখে যে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না, এ কথা অমোঘ সত্য। কঠিন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্যা আছে। যতই দিন যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বারবার আশ্বাস পাওয়া গেলেও বাস্তবে সহায়তা মিলেছে সামান্যই। গত শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের পূর্বাভাস: প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যা ও সংকট তুলে ধরেছেন। এই মুহূর্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট, ঘুষ-দুর্নীতি, সুদের উচ্চ হার, ব্যবসা চালাতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা। এর মধ্যে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার সংকট কিছুটা কেটেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক।
কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া। শিল্পাঞ্চলে প্রায়ই শ্রমিক বিক্ষোভ, অবরোধ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা সময়মতো তাদের পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কার্যাদেশ বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে। উদ্বেগের খবর হলো, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরাধীন অবস্থায় একজন ব্যবসায়ীকে মারধর করার ঘটনা। ব্যবসায়ীরা শিল্পাঞ্চল ও পরিবহনে পূর্ণ নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের আরেকটি উদ্বেগের কারণ, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে হত্যা মামলার আসামি করার ঘটনা।
ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যেসব আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে ব্যবসায়ীরা কতটা আশ্বস্ত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপদেষ্টা ও সরকারের অন্য নীতিনির্ধারকরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চুরি-দুর্নীতির যে ফিরিস্তি দিয়েছেন, সেটা সর্বৈব সত্য। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ তো কেবল ব্যাংকিং খাত নয়। গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে শুরু করে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পরও সরকারি প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না। এখনো ব্যবসায়ীদের সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বদল হলেও চরিত্র বদল হয়নি।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আমরাও একমত যে তিন বা চার মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন। গ্যাস-সংকটের যে সহজ সমাধান নেই। কিন্তু এত দিনেও সরকার শিল্পাঞ্চলে কেন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারল না, সেটি বড় প্রশ্ন বটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি জড়িত। বাণিজ্য উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের নিজেদের ভূমিকা রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। এর মাধ্যমে যদি তিনি শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষায় মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলে থাকেন, সেটি সমর্থনযোগ্য। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, সেটি বিস্মৃত হওয়া যাবে না।
ব্যাংকে তারল্যসংকটের জন্য অতীত সরকারকে দায়ী করা গেলেও বর্তমানের চাঁদাবাজি-ঘুষের দায় নেবে কে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চেহারা বদল হলেও চরিত্র বদল হয়নি। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা চলছে, সেটি কাটিয়ে উঠতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করতেই হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস হলেও দেশে ব্যবসার পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিক কারখানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। এ রকম ভীতিকর পরিবেশ ব্যবসা ও অর্থনীতির জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। 
গত শনিবার (৫ অক্টোবর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি করার যে দাবি জানিয়েছেন, সেটা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ নিরাপদ ও উন্নত না করতে পারার পেছনে বাধা কোথায় এবং ব্যবসার পরিবেশ কীভাবে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের ক্রমাগতভাবে অবনতি হওয়ার তথ্য উঠে আসছিল। এ রকম পরিবেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসার জন্য অনুকূল নয়।
আমলাতান্ত্রিকতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষ-দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে দেশের ব্যবসার পরিবেশ সহজ ও উন্নত করার দাবি দেশের সৎ-নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে সরকারের যে নীতি ছিল, সেখানে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সীমাহীন সুবিধা পেয়েছে। এই গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা, যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে চান, তাঁরা কোণঠাসা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গোষ্ঠীতন্ত্রের অচলায়তন ভাঙার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
ব্যবসা ও শিল্পসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের কথা শোনার কোনো বিকল্প নেই। সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে তারা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে তারা শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। ডিসেম্বর তৈরি পোশাকশিল্পের ভরা মৌসুম, কিন্তু শিল্পাঞ্চলের অস্থিতিশীলতার কারণে ক্রেতারা ইতোমধ্যে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। উদ্বেগজনক এই বাস্তবতার কারণে যেকোনো মূল্যে শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাকশিল্প ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটাও বের করা জরুরি। তবে মজুরি, সুযোগ-সুবিধা ও কাজের পরিবেশ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে স্বল্পমূল্যে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার যে দাবি জানিয়েছেন, সেটাকে আমরা ইতিবাচক বলে মনে করি।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাকে স্বাগত জানিয়ে রাজস্ব খাতে সংস্কারের নজর দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীরা বলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, কাস্টম হাউসগুলোর দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ‘ঠিক জায়গায় ঠিক লোককে বসালে ভালো ফল দেয়’- বলে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর যে মন্তব্য করেছেন, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। 
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

প্যানেল/মো.

×