ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

জ্যৈষ্ঠ-ফল পাকার মধুমাস

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৬:৩৯, ১৪ মে ২০২৫

জ্যৈষ্ঠ-ফল পাকার মধুমাস

বৈশাখের খরতাপের নিতান্ত দগ্ধতার মধ্যে আর এক মধুমাস জ্যৈষ্ঠের শুভাগমন। গ্রীষ্মকালীন সময় পার করতে কাঠফাটা রোদ ভর করা ঋতুকালীন বিপর্যস্ততা। সেখানে ফল পাকার মধুমাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠের যে বন্দনা তা সত্যিই চমকপ্রদ। ‘পাকা ফলের মধুর রসে রঙিন করে মুখ।’ কাব্যিক ঝঙ্কারের এমন আবেদন আমরা শৈশব থেকেই অনুভব করে আসছি। উপাদেয় পাকা ফলের রসনায় স্বদেশের যে ফল-ফুলের আবেদন সেটা বরেন্দ্র পলিমাটির এই অঞ্চলের অভাবনীয় সম্ভার। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ফলের যে বহুমাত্রিকতা তাও আবহমান বাংলার অনন্য সৌরভ। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের ফলের সে সুশোভন রূপ, রস, গন্ধকে মাধুর্যে ভরিয়ে দিতে আবেগঘন কাব্য চয়ন আজও বাঙালির হৃদয়কে আপ্লুত করে যায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের স্মরণে-বরণে সেটা কোনো বর্ণিল সমাগমের অনুষঙ্গ হয় তাও এই বাংলার শাশ্বত নয়নাভিরাম চমকপ্রদ দৃশ্য। পল্লী কবি পল্লী জননীর মোহনীয় আবেশে আপন অভিব্যক্তিতে যেভাবে জয়গানে মুখরিত হন তাই দেশমাতৃকার অনিন্দ্য সুন্দর ছান্দিক পটভূমি। যা শ্যামল পল্লীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রসালো ফলের রূপ, রস, গন্ধের এক অবিমিশ্র দ্যোতনা। বৈশাখের দগ্ধ বাতাসের সঙ্গে আচমকা কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টির যে তাণ্ডব তাও চিরায়ত বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের অমোঘ এক নৈসর্গিক পালাবদল। মধুমাস জ্যৈষ্ঠকে স্বাগত জানাতেই এমন সব রসনাবৃত বাক্যচয়নের প্রস্তুতি, বর্ণনা এবং সাজানো গোছানো। শ্যামল বাংলার হরেক প্রাণ-প্রাচুর্যের আকর্ষণে বিভিন্ন পরিব্রাজক আমাদের দেশভ্রমণ করে যারপরনাই নন্দিত, মুখরিত এবং মাধুর্যময় শব্দ অবগাহনে সমর্পিত। ইবনে বতুতা, বার্নিয়ার, ট্যাভার্নিয়ার সবাই শাশ্বত বাংলার রূপ, রস, গন্ধে ভরা আবহে বিমুগ্ধ বিস্মিত এবং প্রবলভাবে আকর্ষিতও বটে। আর স্বদেশী কবি-সাহিত্যিকদের সৃজন দ্যোতনায়ও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে চিরন্তন বঙ্গভূমির অভাবনীয় লীলাসমৃদ্ধ বাতাবরণ। ধনে, ধানে, পুষ্পেভরা মধুময় এক ভুবন আবহমান বাংলা তার চিরায়ত ফল সম্ভারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠী। জ্যৈষ্ঠের শুভাগমনে তাই সারাদেশ  উদ্বেলিত, আশা জাগানিয়া অপেক্ষা নিয়ে ফল সমাহারে সমর্পণ হতে যেন অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। তবে সময়ের গতিতে, প্রযুক্তি বিদ্যার ক্রমোন্নয়নে স্নিগ্ধ, শান্ত, পুষ্পিত বাংলা কত প্রাচুর্য হারাতে বসেছে তাও এক নৈসর্গের অসহনীয় দাবানল। এক সময়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের হাওয়া বয়ে গেলেও সুশীতল, শান্ত ছায়ায় প্রখর রৌদ্র কেমন যেন সবুজ ঘেরা মমতাময় স্নিগ্ধতার আবেশেও জড়ানো থাকত। কিন্তু প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বিশ্বায়ন হরেক বিপন্নতাকে যেন সম্মুখ সমরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ষড়ঋতু তার পালাবদলের বৈচিত্র্যিক পরিবেশ থেকেও যে ক্রমশ ফারাক হয়ে যাচ্ছে। বৈশাখ মাসে কালবৈশাখী ছাড়াও ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা, প্লাবনও উপকূলবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনকে ভিন্নমাত্রার বৈপরীত্যে আকুল করে তুলছে। ঋতুকালীন সময়ের ফল পাকার মাসও আপন আবহে স্থির থাকতে হিমশিম খায়। তবে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের সহজাত প্রকৃতিতে রসালো ফল পাকা সময়ের অনিবার্যতা। বাজারে এখনো কাঁচা আম, লিচু, কাঁঠাল সেভাবে রসালো হয়ে না পাকলেও ইতোমধ্যে ফলের শুভাগমনে বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার আগ্রহের কমতি নেই। তবে কাঁচা আমের সরবরাহ নজরকাড়া। যা দিয়ে সুস্বাদু আচার বানানো আবহমান বঙ্গ রমণীদের এক ভিন্নমাত্রার আনন্দ আয়োজন। সারা বছরের কাঁচা আমের আচার তৈরিতে বঙ্গ ললনাদের জুরিমেলা ভার। এখন আসলেই কাঁচা আমের সারিতে বাজার সয়লাবÑ সময় যতই গড়াবে পাকা আমের সুমধুর ম-ম গন্ধে বাংলার আকাশ বাতাস যেন মিষ্টি হাওয়ার আবেশে উত্তাল, দিশাহারা। তবে অগ্নিঝরা দগ্ধ বাতাসই ফল পাকার যথার্থ সুসময়। তেমন আকাক্সিক্ষত মৌসুমে আম চাষিরা ফলন থেকে ভোক্তা শ্রেণি উন্মুখ প্রতীক্ষায় দিন গোনে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানে সারি সারি ফলের খেতে নয়নাভিয়াম গন্ধে, বর্ণেও আকাশ-পাতাল ভারি হওয়ার সুসময়। আমাদের জাতীয় ফল কিন্তু কাঁঠাল। যেমন- সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং জনগণের অতি আগ্রহের বিশেষ ফল। শুধু কি ফল? কাঁঠাল বিচি সুস্বাদু রান্নায় ব্যবহৃত এক আবশ্যকীয় রসনা ব্যঞ্জন। যার সঙ্গে শুঁটকি তো বটেই। মাংস এবং মাছের মিলন সৌধে হয়ে ওঠে এক অভাবনীয় রন্ধনশিল্প। তবে পাকা ফলের মধুর রসময় আবহ কিন্তু এক উষ্ণতার অসহনীয় পরিবেশ। যা ফলের মধুময় স্বাদেও দহনজ্বালা সেভাবে কমায় না। দেশের আর এক সুস্বাদু ফল জাম। ছোট ফলটি দৃষ্টিনন্দন, মুখরোচক, টক-মিষ্টির অবিমিশ্র দ্যোতনা। তার চেয়ে বেশি হরেক রোগ-বালাইয়ের মহৌষধ। বিশেষ করে বহুমূত্র রোগের। এমন রোগীর সংখ্যা আমাদের দেশে কম নেই। যারা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে রোগটিকে সামাল  দেওয়া সচেষ্ট হন। আর জাম এমন এক প্রকৃতির সম্ভার যা কি না বহুমূত্র রোগকে বিভিন্নভাবে উপশম দিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে যায়। জামের বিচিও নাকি আরও ফলদায়ক এই রোগ নিরাময়ের। ঋতুভিত্তিক এই ফলটির বিচি সংগ্রহ করে থাকেন সংশ্লিষ্ট রোগীরা। সারা বছরের জন্য। আবার বিচি একত্র করে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। সেই পানি পান করাও নাকি এই রোগের জন্য বিশেষ উপকারি। টক-মিষ্টিতে লিচুর আবেদনও কম কিছু নয়। সুস্বাদুই শুধু নয় স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। ছোট্ট এই বাংলাদেশে বিচিত্র ফলের সমাহার হলেও কিছু অঞ্চলভিত্তিক ভূমিতে নির্দিষ্ট ফলনের প্রাচুর্য দৃশ্যমান। যেমন-আম রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। যদিও সারা বাংলাদেশের সিংহভাগ জেলায় আমের ফলন কম নয়। এখন কুষ্টিয়ার আমও জনগণের মাঝে সাড়া জাগাচ্ছে। আর লিচু বলতে দিনাজপুরের লিচুই সকলের কাছে প্রিয়। তবে রাজশাহীসহ দেশের অনেক জেলায় লিচু গাছের দৃষ্টিনন্দন ফলন রয়েছে। তবে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের মতে এই দেশে বীজ মাত্রই নাকি সোনা ফলে। তবে কিছু প্রাকৃতিক বৈপরীত্যে অঞ্চলভিত্তিক পার্থক্যও নজরে আসে। মে-জুন মাসে রাজশাহীতে যে খরতাপ তা অন্য যে কোনো জেলার চেয়ে তীব্র। তেমন  গরমে ফল পাকার সুবর্ণ সময় বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ফলন চাষিরা অভিমত ব্যক্ত করেন। এক নজরে সারা বাংলাদেশ উপলব্ধি করতে গেলে বড় ধরনের ফারাক সেভাবে দৃশ্যমান নয়। পলি মাখানো এই উর্বর বরেন্দ্র ভূমিটি আসলে শস্য থেকে ফল-ফুল উপাদানে আজও বিশ্বে নজরকাড়া অবদান রেখে যাচ্ছে। আর মাছে ভাতে বাঙালির চিরায়িত সৌরভে মাছ উৎপাদন আর রপ্তানিতে বিশ্বে নজরকাড়া স্থান দখল করে আছে। সময় নিকট প্রায়। ফল পাকার মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চল এক অভাবনীয় সৌরভ আর শৌর্যে মাতোয়ারা হবে। পুরো জুন মাসেই চলবে আম পাকার ধুম। যা এই অঞ্চলের সাংবাৎসরিক বৈভব। গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি সর্বশেষ আম্রপলি। প্রখর রৌদ্রতাপে ফল পাকার যে ধুম তাতে জনগণের অস্থিরতার সঙ্গে রসনাতৃপ্ত ফলাহারও বাড়তি সম্ভার।

প্যানেল

×