ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

জাতিসংঘের প্রতিবেদন

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘন

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ২০:১২, ৫ মে ২০২৫

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘন

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে হাজার বছরের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান বিশ্বের মুক্তিকামী মানবতাকে আলোর পথ দেখাবে অনন্তকাল। এ দেশের খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ দেশের ক্রান্তিকালীন প্রতিটি মুহূর্তে ঢাল হয়ে, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। সাড়ে পনেরো বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে মুজিববাদী আদর্শের মোড়কে এক দলীয় শাসন কায়েম, ভিন্নমত দলনে হাজার হাজার মানুষ খুন ও গুম করে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, মেগা প্রকল্পের নামে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর করে দেওয়া, অবশেষে দেশের মানুষের গণবিদ্রোহে পালিয়ে গিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী প্রেতাত্মাদের বিদেশে আয়েশি জীবন যাপন শুরু হয়েছে।
গত বছর জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, তার ওপর জাতিসংঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০২৪ সালের ৫ জুন, একটি রায়ের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় দেয়। উচ্চ আদালতের এ রায়ে তাৎক্ষণিক  বিক্ষোভ করে দেশের ছাত্র সমাজ। তবে দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে  জনরোষ ছিল বহু আগ থেকেই। যার শিকড় প্রোথিত ছিল রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোর মধ্যে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণের ফলে প্রকট হয়ে উঠেছিল নারী-শিশুসহ দেশের মানুষের গণদাবি। আওয়ামী লীগ সরকার জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ব্যাপক সহিংস পন্থা অবলম্বন করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ২৩ জুলাই প্রথমবারের মতো একটি চিঠির মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি তথ্য-সংগ্রহ (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) মিশনের প্রস্তাব দেন। সে সময় বাংলাদেশের সংকট ছিল তীব্রতম পর্যায়ে। সেই প্রস্তাবের কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। ১৪ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাইকমিশনারের সঙ্গে এক ফোনালাপে ‘অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস’কে (ওএইচসিএইচআর) একটি তথ্য-সংগ্রহ মিশন পরিচালনার অনুরোধ জানান। ২৮ আগস্ট, ২০২৪ তারিখের এক চিঠির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান তিনি। সেই অনুরোধ ও আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। যে  দলে একজন ফরেনসিক চিকিৎসক, অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, লিঙ্গবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ওপেন-সোর্স বিশ্লেষক, গণমাধ্যম ও আইনি পরামর্শক ছিলেন। ওএইচসিএইচআরের সদস্যগণ বিক্ষোভস্থল, যেমনÑ বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালসহ ঢাকা, সিলেট, রংপুর ও নরসিংদীর প্রধান বিক্ষোভকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। দলটি এসব স্থানের ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এ ছাড়া কুমিল্লা, গাজীপুর, জামালপুর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অতিরিক্ত ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলে। ওএইচসিএইচআর সংগৃহীত সকল তথ্যের ভিত্তিতে বলেছে, পতিত সরকারের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠন যৌথভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে বলপ্রয়োগে গুরুতর আহতকরণ, ব্যাপক নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ ঘটেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তিসংগত বিশ্বাস রয়েছে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, সমন্বয় ও নির্দেশনার মাধ্যমে সরাসরি পরিচালিত হয়েছে। যার উদ্দেশ্য ছিলÑ বিক্ষোভ ও সংশ্লিষ্ট ভিন্নমত দমন করা। এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের বিষয়, যা অতিরিক্ত ফৌজদারি তদন্তের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করে। যাতে নির্ধারণ করা যায় যে, এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে নির্যাতন ও দেশীয় আইনের অধীনে গুরুতর অপরাধভুক্ত।
দেশজুড়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ যখন গণবিদ্রোহে পরিণত হয়, তখন মধ্য জুলাই থেকে সরকারের এমপি, মন্ত্রী  এমন কী ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীদের উসকে দেওয়া হয়। তারা বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে ও আশপাশে শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণ চালায়। শিক্ষার্থীদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে দেখে আওয়ামী সরকার আরও গুরুতর সহিংসতার আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ পুলিশ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের সহযোগিতায় ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত  শান্তিপূর্ণ ছাত্রবিক্ষোভকে অত্যধিক ও অপ্রয়োজনীয় শক্তিপ্রয়োগ করে দমন করে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থি।
এই ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা একটি সাধারণ বিক্ষোভ এবং  কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করে। দেশের বড় দুটি দল বিএনপি ও জামায়াত তাতে সমর্থন দেয়। তৎকালীন সরকার সংগঠক ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দেয়। বেঁচে থাকার অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেড়ে নেয় র‌্যাব ও পুলিশ। তারা হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে চক্কর দেয় বিক্ষোভকারীদের ভীত করার জন্য। মাটিতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি মিলে সামরিক রাইফেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে,  যাতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়। প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাস্তা ও নির্দিষ্ট কিছু স্থাপনা অবরোধ করার চেষ্টা করেছিল। তারা মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ আচরণই করছিল। তবে কিছু বিক্ষোভকারী নিজেদের রক্ষার জন্য পাল্টা প্রতিরোধ হিসেবে ইটপাটকেল ছোড়ে ও লাঠি চালায়। ১৯ জুলাই থেকে বিক্ষোভের শেষদিন পর্যন্ত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলি চালায়। যার ফলে বহু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আহতের ঘটনা ঘটে, যাদের মধ্যে বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করা সাংবাদিকরাও ছিলেন। রাজধানী ঢাকাসহ কিছু স্থানে নিরাপত্তা বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের খুব কাছাকাছি দূরত্ব থেকে (পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ) গুলি করে তাৎক্ষণিক হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত করে।
গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবি, এসবি, সিটিটিসি এবং এনটিএমসি বিক্ষোভকারীদের সহিংস দমনে সরাসরি জড়িত ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনে। তারা নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন। সিটিটিসি সদরদপ্তরও এমন একটি স্থানে পরিণত হয়েছিল, যেখানে নির্বিচারে আটক রাখা হতো। আটককৃতদের মধ্যে শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিবি ও ডিজিএফআই একসঙ্গে কাজ করে ছাত্রনেতাদের অপহরণ ও নির্বিচারে আটকের ঘটনা ঘটায় এবং তাদের বিক্ষোভ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যরা জীবন-রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবায় বাধা সৃষ্টি করে। তারা প্রায়ই হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করত, আহত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করত এবং চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীদের ভয় দেখাত। কোনো প্রসিকিউটর এসব অপরাধে জড়িত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
একটি সংগঠিত ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভার আদেশ বাস্তবায়ন করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল জনগণকে কৌশলে বিভ্রান্ত করা। এ সময়ে ডিজিএফআই, এনএসআই ও র‌্যাব ঢাকার  গণমাধ্যমগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে। যাতে তারা গণবিক্ষোভ ও তার সহিংস দমন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ও সত্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ না করে। ডিজিএফআই পুলিশের সঙ্গে মিলে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও আইনজীবীদের ভয় দেখিয়ে চুপ থাকতে বাধ্য করে।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রের ভিত্তিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত করতে পেরেছে যে, পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত ও সংগঠিত (সিস্টেমেটিক) প্রচেষ্টায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণ জ্ঞাতসারে, সমন্বয়ে এবং নির্দেশনায় সংঘটিত হয়েছে। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামোর সমন্বয় সাধনে সমান্তরাল প্রচেষ্টা চালান। উভয়েই মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে একাধিক সূত্র থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন সংগ্রহ করতেন। ২১ জুলাই এবং আগস্টের প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রীকে সরবরাহ করা প্রতিবেদনে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারীর ও অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্বিচার আটক পরিচালনার জন্য সরাসরি আদেশ ও নির্দেশ জারি করেছিল।
২০২৪ সালের আগস্টের শুরুর দিকে, যখন সাবেক সরকার ক্রমাগত দেশের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল, তখন জনতা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য গুরুতর প্রতিহিংসামূলক সহিংসতায় লিপ্ত হয়, যা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। বিক্ষোভচলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, আহমদিয়া মুসলমান ও চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর ওপর সহিংস হামলা চালানো হয়। যার মধ্যে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং কিছু উপাসনালয়ে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এই হামলাগুলোর পেছনে ভিন্ন ভিন্ন এবং কখনো কখনো পরস্পর-সংযুক্ত উদ্দেশ্য কাজ করেছে। যার মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সুযোগ হিসেবে দেখা, স্থানীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ (বিশেষ করে জমি নিয়ে) এবং ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কিছু স্থানীয় সমর্থক প্রতিশোধমূলক হামলায় জড়িত ছিল। তবে ওএইচসিএইচআরের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী এসব ঘটনা এই দলগুলোর জাতীয় নেতৃত্বের দ্বারা  সংঘটিত হয়নি। বরং তাদের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানানো এবং নিরাপত্তা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর হামলায় জড়িত অনেক অপরাধী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ওএইচসিএইচআর সরকারি ও বেসরকারি উভয় উৎস থেকে সংকলিত তথ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করেছে যে, বিক্ষোভ চলাকালীন ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বিশাল অংশ বাংলাদেশের সামরিক রাইফেল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী ছররা গুলি দ্বারা নিহত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে আনুমানিক ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে। হাজারো মানুষকে ইচ্ছাকৃত পঙ্গু করে দেওয়া হয়। গুরুতরভাবে আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই আঘাতগুলোর অধিকাংশই ছিল প্রাণঘাতী। পুলিশ ও র‌্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ১১,৭০০ জনের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার ও আটক হয়েছে।
জাতিসংঘের এই মানবাধিকার সংগঠন সুপারিশ করছে, বিক্ষোভ সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নিপীড়নের আরও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করা প্রয়োজন, যাতে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যায়।  বাংলাদেশকে অব্যাহত সহায়তা ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে ওএইচসিএইচআর। প্রতিবেদনের ফল ও সুপারিশ ২৩০টির বেশি একান্ত সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। সরকার, নিরাপত্তা খাত ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেক সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যারা সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জানেন।
‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়ন’ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রচ্ছদ প্রকাশন।
ফ্যাসিবাদবিরোধী চিন্তাবিদ দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তক, সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট, অধ্যাপক, গবেষকÑ এক কথায় স্বৈরশাসন ও একনায়কতন্ত্র নিয়ে যারা পিএইচডি-এমফিল করবেন, তাদের সবার জন্য এক সুখপাঠ্য বয়ান। জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিদেশীদের চোখে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সাতকাহন ফুটে উঠেছে নির্মোহ মননে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক ছাত্র রোকন উদ্দিন খান, একজন পেশাদার অনুবাদক হিসেবে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বইটির স্তরে স্তরে। আগামীর বৈষম্যহীন, সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতিসংঘের প্রতিবেদন হোক চলার পথের পাথেয়।
লেখক : সাংবাদিক

প্যানেল

×