
ক্যাশলেস লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব থেকে অনেক পিছিয়ে আছে
অত্যাধুনিক যুগে গ্যালোপিং আকারে চলমান জীবনের সব শাখায় একের পর এক ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। মনুষ্য জীবনের কর্মকা- বড় জটিল। তাই এটি সহজ করার জন্য নানা রকম বিজ্ঞানপ্রসূত কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ক্যাশলেস লেনদেন। অবশ্য মনুষ্যজীবনের প্রথমভাগে বার্টার হিসেবে ক্যাশলেস লেনদেন ছিল, তবে তা এভাবে নয়।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারের অনস্বীকার্য অনেক সুবিধা আছে। যেমনÑ ক্যাশলেসের ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোনো সময় এক জায়গা থেকে অন্য কোনো জায়গায় সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়। তাছাড়া ক্যাশলেস ব্যবস্থায় টাকা তৈরির খরচ নেই বললেই চলে। অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। আর্থিক অপরাধ সংখ্যা কমে যায়। এ ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার সম্ভাবনা তেমন থাকে না।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, নগদহীন অর্থনীতির প্রাথমিক ধারণা দেন অ্যাডওয়ার্ড বেলামি তাঁর ‘লুকিং ব্যাকওয়ার্ড’ উপন্যাসে। এতে তিনি নগদবিহীন লেনদেন এবং দৈনন্দিন জীবনে নিষ্পত্তির প্রবণতার কথা তুলে ধরেন। উল্লেখ্য, ১৯৯০ এর দশকে যখন ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, তখনই ক্যাশলেস পদ্ধতির পথ সুগম হয় এবং তৎপর সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কালক্রমে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০১০-এর দশকে জিডিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিগুলো ব্যাপকভাবে রূপ নেয়। এর সপক্ষে উদাহরণ হলোÑ পেপ্যালের মতো মধ্যস্থতাকারী, অ্যাপল পে-এর মতো ডিজিটাল ওয়ালেট সিস্টেম, ইলেকট্রনিক কার্ড বা স্মার্টফোন ইত্যাদি। এর মাধ্যমে এনএফসি অর্থপ্রদান, ইলেকট্রনিক বিল এবং ব্যাংকিং সবই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে ভার্চুয়াল মানিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও এটিকে অনেক দেশ তেমন ভালো চোখে দেখে না।
সঙ্গতকারণেই বাংলাদেশের ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা সমীচীন বলে মনে করি। সত্যিকারার্থে আমাদের দেশে কাগুজে নোটের প্রচলন বেশি। এসব নোটের স্থায়িত্ব সাধারণত ৬ থেকে ৮ মাস। এই সময়ের মধ্যেই অধিকাংশ নোট ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। অথচ কয়েন দীর্ঘস্থায়ী। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে পলিমার নোট ছেপেও খুব একটা ভালো ফল পাওয়া যায়নি।
এদিকে অগ্রহণযোগ্য পুরানো নোট তুলে নিয়ে বিনষ্ট করে নতুন নোট ছাপাতে প্রতিবছরে সরকারের খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৪ থেকে ৫ শত কোটি টাকা। অনেকে বলে থাকেন যে, দেশের মানুষের ব্যবহারের পদ্ধতিগত কারণে কাগুজে নোটের স্থায়িত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তবে খরচ বেশি পড়লেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্ব তুলনামূলক অনেক বেশি। উল্লেখ্য, ছেঁড়া-ফাটা নোট বিনিময় করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।
আর কাজটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব নোটের বিপরীতে পরবর্তী সময়ে ইস্যু করে নতুন নোট। এদিকে চলমান চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। যে ভাবেই বলি না কেন, এর খরচ কমাতে ক্যাশলেস লেনদেনের বিকল্প নেই। যদিও সরকার এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করছে। তাছাড়া দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন টাকার নক্সায় পরিবর্তন আনছে সরকার। বলতে গেলে, সব ধরনের নোটের নক্সা পরিবর্তন হবে।
অবশ্য এর আগে ডিজাইন অক্ষুণœ রেখে শুধু প্রিন্ট করা হতো। এবার নতুন নোটে থাকবে না আগের ছবি। যুক্ত হবে ধর্মীয় স্থাপনা, বাঙালি ঐতিহ্যসহ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের গ্রাফিতি। পুরনো ডিজাইনের নোট ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সবকিছু মিলে আগের তুলনায় বাড়বে নতুন নেটের পরিমাণ।
এর আগে টাকা ছাপতে বছরে প্রায় পাঁচ শত কোটি টাকার মতো খরচ হলেও এবার খরচ পড়বে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এদিকে টাকা ছাপাতে হলে সঙ্গতকারণেই কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। আগেই বলেছি যে, ছাপানো নোট মাত্র ছয় মাসেই নষ্ট হয়ে যায়। সে নোটগুলো (ছেঁড়া-ফাটা) বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
পুড়িয়ে ফেলার অব্যবহিত পর সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহ সমুন্নত রাখতে নতুন নোট ছাপানো হয়। শুধু তাই নয়, এখানে যে কথাটি উঠে আসে, তা হলো কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার? আর সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়। এবার সব ধরনের নোটের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং সেই আলোকে নোট ছাপানো হচ্ছে। তবে কয়েনের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
স্বাভাবিকভাবেই এবার তিন গুণ পর্যন্ত খরচ বাড়বে। কেননা, এবারের হিসাবটা কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় নতুন নোট ছাপাতে লাগছে বাড়তি টাকা। তবে সাধারণ সময়ে নোটপ্রতি খরচের একটি হিসাব আছে। এ হিসাব শুধু ছাপানোর জন্য প্রযোজ্য। তথ্য মতে জানা যায়, সাধারণত ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে ৪ টাকা ৭০ পয়সা।
এছাড়া ২০০ টাকার নোটে ৩ টাকা ২০ পয়সা; ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা। ১০, ২০ ও ৫০ টাকার সবগুলো নোটেই দেড় টাকা করে খরচ পড়ে। এতদ্ব্যতীত ৫ টাকা ও ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে ১ টাকা ৪০ পয়সা করে।
সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে। কারণ, প্রতিটি কয়েনে সমপরিমাণ টাকা খরচ পড়ে যায়। এদিকে বিশ্বব্যাপী কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এই খরচ কিছুটা বেরেছে। সেহেতু কাগুজে নোটে খরচ বেশি পড়ায় বিকল্প চিন্তাও করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্যাশলেসের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ছোট-বড় দোকান কিংবা মার্কেটে বসানো হয়েছে কিউআর (কুইক রেসপন্স) কোড।
যার মাধ্যমে লেনদেন করছেন মানুষ। অবশ্য আগেও এই মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে ১০ টাকা থেকে সব ধরনের পেমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তবে কিউআর কোডের মাধ্যমে সর্বত্র লেনদেনের ধারণা, সচেতনতার অভাবে খুব বেশি একটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।
এক্ষেত্রে সঙ্গতকারণেই ক্যাশলেস সোসাইটির কথা উঠে আসে। মূলত এই ধরনের সোসাইটির দিকে অগ্রসরের অর্থ হলো, যেখানে নগদ তার ডিজিটাল সমতুল্য ডিভাইস দ্বারা প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। এখানে আইনি দরপত্র (টাকা) বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, ইলেক্ট্রনিক ডিজিটাল আকারের বিনিময়সহ রেকর্ডভুক্ত করা হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পৃথিবীর ক্যাশলেস বিপ্লবের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কীভাবে এই লেনদেন এগিয়ে যাচ্ছে? এ সূত্র ধরে পরিলক্ষিত হয় যে, ৫৪টি দেশ পুরোপুরি ক্যাশলেস হওয়ার পক্ষে। কেবল ৩২টি নগদ লেনদেনের মধ্যে থাকতে চায়। বস্তত ক্যাশলেস লেনদেনের শীর্ষে অবস্থান করছে সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আগামী বিশ^ নগদকে পেছনে ফেলে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে দ্রুত হাঁটছে।
এখানে বিশেষ একটি উদাহরণ হলো সুইডেনে বর্তমানে নগদে অর্থের ব্যবহার প্রায় বন্ধ। মাত্র ১০ শতাংশের কম সংখ্যক মানুষ নগদ ক্যাশে লেনদেন করে। একই পথে এগোচ্ছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের ৯০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এখন ক্যাশলেস ব্যবস্থার আওতায় চলে এসেছে।
বিশেষজ্ঞর মতে, সুইডেন হয়তো পৃথিবীর প্রথম দেশ হবে, যেখানে পুরাপুরি ক্যাশলেস সোসাইটিতে রূপান্তরিত হবে। অবশ্য চীনও পিছিয়ে নেই। কেননা, ক্যাশলেস পেমেন্টের পথিকৃৎ রূপে চীনের আলি পে ও উইচ্যাট পে টেনসেন্ট মোবাইলের পেমেন্টের মাধ্যমে অনেক আগেই ক্যাশলেস যাত্রা শুরু করেছিল। আপনারা কীভাবে নেবেন জানি না, কোভিড-১৯ কিন্তু প্রায় দেশে ক্যাশলেস লেনদেনের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে দিয়েছে।
কথায় বলে, প্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকে। এই প্রবচনের সারথী ধরে উল্লেখ্য যে, এর কিছু উদ্বেগপূর্ণ বিষয় আছে। যা হলো এক্ষেত্রে প্রাইভেন্সি হ্রাস পায় এবং হ্যাকিংয়ের কারণে চুরির বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হয় না। তাছাড়া অতিমাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে স্বকীয়তা কমে আসে এবং একই সঙ্গে প্রান্তিক গোষ্ঠী, যাদের স্মার্ট ফোন নেই, তাদের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তথাপি এর উপকারিতা অগ্রসরমান সমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ বললে বেশি বলা হবে না।
পুনরায় বাংলাদেশের কথায় ফিরে আসি। বস্তুত ক্যাশলেস ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে তফসিলি ব্যাংক ছাড়াও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানিগুলো জনপ্রিয় করেছে অ্যাপভিত্তিক ক্যাশলেস লেনদেন এবং যুগপৎ কুইক রেসপন্স (কিউ আর) কোড ব্যবহার করে থাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, কিউ আর হলো বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির পেমেন্ট প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্মে যুক্ত যে কোনো ব্যাংক এমএফএসের গ্রাহককে কুইক রেসপন্সের কোডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারে। যাহোক, ক্যাশলেস লেনদেন আগের চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়েছে। ই-কমার্স লেনদেনে অ্যাপের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড।
দেশে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ লেনদেন করছে ক্যাশলেস মাধ্যমে। তথ্য মতে জানা যায়, এটিএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও বাংলা কিউ আর ব্যবহার করে মানুষ প্রতিদিন প্রায় গড়ে হাজার কোটি টাকা লেনদেন করে। এর মধ্যে ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ১০টি ব্যাংক, ৩টি মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা এবং ৩টি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমকে এ কাজে প্রাথমিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, আমাদের দেশেও বিভিন্ন শপিং মলে পণ্য বেচাকেনায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফসি) প্রতিষ্ঠান বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, শিওর ক্যাশ ও নগদে কিউআর কোড পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এতদিন যাবৎ গুটিকয়েক ব্যাংক ও এমএফএসের কিউ আর থাকলেও সর্বজনীন কিউ আর ছিল না। ফলে পারস্পরিক লেনদেনে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। এই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বজনীন বাংলা কিউ আর প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয় বিধায় সে সব জটিলতা অনেক ক্ষেত্রে কেটে উঠেছে।
পরিশেষে বলতে চাই যে, ক্যাশলেস লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নত বিশ^ থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তাই গ্লোবালী সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে এই পদ্ধতিকে আরও গতিশীলকল্পে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এদিকে গ্লোবালী ক্যাশলেস সোসাইটি যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, এমন একদিন আসবে, যখন নগদ ক্যাশ তো দূরে থাক, আনুষ্ঠানিক ব্যাংক বলে কিছু থাকবে না। শুধু হাতে রাখা স্মার্ট ফোন কিংবা এর স্থলে নতুন কোনো ডিভাইস ব্যাংকের সব রকম ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
[email protected]/w.goonijon.com