ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে, তাতে জড়াবে চীন-রাশিয়া!

প্রকাশিত: ১৯:১৪, ৪ মে ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে, তাতে জড়াবে চীন-রাশিয়া!

ছবি: সংগৃহীত

শুরু হোক একটি প্রশ্ন দিয়ে— মধ্যপ্রাচ্য কি আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে? আর সেই যুদ্ধ কি কেবল ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি রূপ নেবে এক বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংঘাতে? ২০২৫ সালের শুরু থেকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন করে তীব্র উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং বিপজ্জনক।

মূল ইস্যু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র উদ্বেগ। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি— জেসিপিওএ— যার মাধ্যমে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করেছিল এবং এর বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছিল, ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা সরে দাঁড়ানোর মাধ্যমে ভেঙে পড়ে। এরপর ইরান আবারও তার পারমাণবিক কর্মসূচি সক্রিয় করে তোলে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যেখানে মাত্র ৯০ শতাংশেই এটি অস্ত্র গ্রেডে পরিণত হয়।

এমন পরিস্থিতিতে দু’পক্ষের মধ্যে যেটুকু কূটনৈতিক আলোচনা চলছিল, তা হঠাৎ করেই স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা ইরানের অনমনীয় অবস্থানে হতাশ, আর ইরানও স্পষ্ট জানিয়ে দেয়— জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা আর কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অচলাবস্থার কারণে কূটনীতির পথ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এবং সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে— যদি সম্ভাব্য চুক্তিগুলো ভেস্তে যায় এবং যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তার মাত্রা কতটা বিস্তৃত হবে? যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের সব ধরনের বিকল্প ‘টেবিলে’ রয়েছে— যার মধ্যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক হামলার কথাও রয়েছে। ইসরাইল তো বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে—প্রয়োজনে এককভাবেই ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করতে তারা প্রস্তুত।

এই মুহূর্তে ইরানের মিত্র গোষ্ঠীসমূহ— যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ারা— যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই উত্তেজনা এখন আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর শেকড় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব রাজনীতির আরও গভীরে— বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার দিকে।

রাশিয়া, যারা ইতোমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িত, তাদের দৃষ্টিতে ইরান দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র। সিরিয়া যুদ্ধে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাশিয়ার জন্য ইরান এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া সরাসরি লড়াইয়ে না নামলেও গোয়েন্দা সহায়তা, সাইবার হামলা কিংবা উন্নত অস্ত্রের মাধ্যমে ইরানকে সাহায্য করতে পারে।

অন্যদিকে চীন, যারা ইরানের অন্যতম বৃহৎ তেল ক্রেতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় আগ্রহী, প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও পেছনের কৌশলে অনেকটাই মাপজোখ করছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে মধ্যপ্রাচ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযানে নামে, তখন চীন শুধু ‘দর্শক’ হয়ে থাকবে কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

গত কয়েক বছরে ইরান, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বেড়েছে— যৌথ সামরিক মহড়া, প্রযুক্তি বিনিময় ও ডলারের বাইরে বাণিজ্যের মতো উদ্যোগগুলো এক নতুন জোটের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

এই সম্ভাব্য যুদ্ধ হবে না কেবল মিসাইল বা বোমার লড়াই। এটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক, সাইবার এবং তথ্য যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশ ছুঁতে পারে, তৈরি হতে পারে খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি। এখন দেখার বিষয়— এই উত্তেজনা কি শেষ পর্যন্ত এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে রূপ নেবে, নাকি কূটনীতির শেষ আলো এখনো জ্বলছে কোথাও?

ভিডিও দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=7pr02yCeUkc

এম.কে.

×