
ছবি: সংগৃহীত
সত্যি কথা বলতে কী, প্রতিটি বাবা-মায়েরই চাওয়া থাকে সন্তানের মঙ্গল। চাই তারা হোক বুদ্ধিমান, হাসিখুশি, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর — যেন যে কোনো জায়গায় প্রবেশ করেই নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারে। কিন্তু স্কুল, হোমওয়ার্ক, স্ক্রিন টাইম আর নানা কোর্সের ব্যস্ততায় আমরা অনেক সময় এমন কিছু অভ্যাস উপেক্ষা করি, যেগুলোর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী — আর যেগুলোর জন্য কোনো খরচও লাগে না।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এমন কোন দৈনন্দিন অভ্যাস রয়েছে যা সন্তানের মেধা, মন ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে?
উত্তরটা খুবই সহজ — প্রতিদিন সন্তানের সঙ্গে অর্থবহ একান্ত কিছু সময় কাটানো।
হ্যাঁ, প্রতিদিন মাত্র ১৫-৩০ মিনিটের নিখাদ মনোযোগ ও সান্নিধ্যেই হতে পারে এই পরিবর্তনের শুরু।
কেন এই অভ্যাস ম্যাজিকের মতো কাজ করে?
এটা কোনো হোমওয়ার্ক দেখা বা গাড়িতে বসে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো নয়। এটা একান্ত মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ একসঙ্গে থাকা — কোনো ডিসট্র্যাকশন নয়, মাল্টিটাস্কিং নয়। হতে পারে সেটা গল্প করা, বই পড়া, একসঙ্গে রান্না করা, কিংবা শুয়ে শুয়ে অদ্ভুত কিছু কথা বলা।
এই সংযোগ সন্তানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ‘বালতি’ পূর্ণ করে:
* ভালোবাসা ও নিরাপত্তার বালতি,
* জ্ঞান ও কৌতূহলের বালতি,
* আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার বালতি।
সন্তান যখন বুঝে যে তারা প্রতিদিনের ব্যস্ততায়ও আপনার অগ্রাধিকার পাচ্ছে, তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক গভীর নিরাপত্তাবোধ। আর নিরাপদ একটি মন শেখে ভালোভাবে, আচরণ করে ইতিবাচকভাবে, আর নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে।
এটা তাদের মেধাকে শানিত করে মাথা গরম করে ফ্ল্যাশকার্ড দেখানো বা প্রতিদিন পাজল দিয়ে সময় কাটানোর দরকার নেই। শুধু কথা বলুন। জানতে চান তাদের চিন্তা, বলুন আপনার দিন কেমন গেল। আলোচনা করুন সিনেমা, খেলা বা আকাশের মেঘের রূপ নিয়ে। প্রশ্ন করতে দিন, এমনকি যদি প্রশ্নটা হয় — "কুকুরেরা কি ভূত দেখতে পায়?" বা "মানুষের যদি লেজ থাকত?"
এই ধরনের কথোপকথন বাড়ায় শব্দভান্ডার, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, স্মৃতি শক্তি এবং সাধারণ জ্ঞান। গবেষণায় দেখা গেছে, পিতামাতার সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথন শিশুদের ভাষা বিকাশ এবং মস্তিষ্কের বৃদ্ধিতে সহায়ক।
উপরি পাওনা?
আপনি শেখাচ্ছেন কীভাবে শোনা যায়, প্রশ্ন করা যায় এবং চিন্তাভাবনা প্রকাশ করা যায় — যা স্কুল, সমাজ ও ভবিষ্যতের জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এটা তাদের করে আরও সুখী শিশুরা মনোযোগ চায় — সেটা কোনো বিরক্তিকর চাহিদা নয়, বরং এটা তাদের জানিয়ে দেয় যে তারা গুরুত্বপূর্ণ। যখন আপনি সব কিছু থামিয়ে শুধু ওদের জন্য সময় বের করেন, ওদের ‘ইমোশনাল ব্যাটারি’ চার্জ হয়ে যায়।
ফলাফল?
মেজাজ ভালো থাকে, কান্নাকাটি কমে, এবং তারা আরও সহযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। কারণ তারা অনুভব করে — "আমি গুরুত্বপূর্ণ। আমার সঙ্গে সময় কাটানোটা আনন্দের।"
সত্যি বলতে কী, এই অনুভূতি আমরা প্রত্যেকেই তো চাই, তাই না?
এটা গড়ে তোলে আত্মবিশ্বাস আত্মবিশ্বাস শুধু প্রশংসা দিয়ে তৈরি হয় না। এটা তৈরি হয় সক্ষমতা, বিশ্বাস এবং নিঃশর্ত গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে।
প্রতিদিনের সেই সময়টুকু ওদের জন্য এক নিরাপদ জায়গা তৈরি করে — যেখানে ওরা নিজেদের খুলে বলতে পারে। স্কুলে কে কী বলল, কী নিয়ে ভয় লাগল, কী নিয়ে গর্ব বোধ করছে — এই সব কথা যখন ওরা বলতে পারে, তখন আপনি ওদের শেখাচ্ছেন:
"আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি। আমি নতুন কিছু চেষ্টা করতে পারি। আমি ভুল করতে পারি — তবুও আমি ভালোবাসা পাব।"
এই বিশ্বাসই এক অটল আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি।
তাহলে, সময় কোথায় পাবেন? হ্যাঁ, প্রতিদিন এটা করা সব সময় সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু এখানে গুণ নয়, মূল কথা গুণমান।
সহজ কিছু আইডিয়া:
* রাতের খাবারের পর হেঁটে আসা।
* একসঙ্গে কিছু রান্না করা — ইনস্ট্যান্ট নুডলস হলেও চলবে!
* ঘুমানোর আগে জড়িয়ে গল্প করা।
* একসঙ্গে একটি অধ্যায় পড়ে ফেলা।
* মেঝেতে শুয়ে খেলা বা শুধু গল্প করা।
* একটি ছোট ভিডিও দেখে নিয়ে আলোচনা।
* আঁকা-আঁকি, দুডুল করা — কিংবা কিছু না করে শুধু পাশে বসে থাকা।
যদি একাধিক সন্তান থাকে?
একদম বুঝতে পারছি — একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে সময় বের করা কঠিন। তবে সমাধান আছে — রোটেশন করুন। হয়তো এক সন্তানের জন্য সোমবার ও বুধবার, আরেকজনের জন্য মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার। কিংবা ঘুমানোর আগের সময়টাও হতে পারে একান্ত কিছু মুহূর্ত।
এমনকি ছোট্ট একটি প্রশ্ন — “আজকের সবচেয়ে মজার ও সবচেয়ে আজব বিষয়টা কী ছিল?” — এটাও হতে পারে সংযোগের বড় একটি সুযোগ।
একটা দিন মিস হয়ে গেল? সমস্যা নেই। জীবন চলে তার নিজস্ব গতিতে। কখনো ক্লান্তি, কখনো ব্যস্ততা। যদি একদিন বাদ পড়ে যায়, guilt ফিল করার দরকার নেই। এটা কোনো নিয়ম নয় — এটা একটা অভ্যাস। আজ মিস হলো? কাল আবার শুরু করুন।
মূল কথা হলো — শিশুটি যেন জানে, “আমি আমার বিশেষ সময়টা আবার পাব।”
আসিফ