
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব রাজনীতির উত্তপ্ত মঞ্চে এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—ইরান কি গোপনে পারমাণবিক বোমা বানাতে পারবে? বর্তমান বাস্তবতা বলছে, কাজটা সহজ নয়। কারণ ইসরায়েল এর আগেও দেখিয়েছে, তারা কীভাবে ইরানের ভেতরে ঢুকে গোপন প্রকল্প ফাঁস করতে এবং তাদের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের সরিয়ে দিতে পারে।
চার বছর আগে এক সকালে রাজধানী তেহরানের উপকণ্ঠে নিজের গাড়িতে করে স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদে। হঠাৎ একটি পিকআপ ট্রাকে বসানো রিমোট-কন্ট্রোলড মেশিনগান তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।
তিনি ছিলেন ‘প্রজেক্ট আমাদ’-এর স্থপতি—যেটি ইরানের গোপন পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প হিসেবে পরিচিত ছিল।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কতটা ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলের হামলায় আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী নিহত হওয়ায় সেই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়েছে।
গোপন অস্ত্র কর্মসূচিতে বাধা: নজরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এরিক ব্রিউয়ার বলেন, ‘ইরানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গোপন রাখার বিষয়টি। কারণ ইসরায়েল একাধিকবার প্রমাণ করেছে তারা চাইলেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গভীরে ঢুকে পড়তে পারে এবং প্রয়োজনে হামলা চালাতে পারে।’
ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ইরান তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডেও যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের হামলা ঠেকাতে অপারগ বলে দাবি করেন মার্কিন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক ও সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপোলোস বলেন, ‘ইসরায়েলের গোয়েন্দা শক্তি ইরানের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। কোনো হুমকি তারা টের পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেবে—তা সামরিক হামলা হোক বা গোপন অভিযান।’
অতীতের প্রচেষ্টা: ধরা পড়ে যাওয়া ‘গোপন প্রকল্প’
২০০২ সালে উপগ্রহ চিত্রে ইরানের নাতাঞ্জে গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র এবং আরাকে ভারী পানি প্লান্টের সন্ধান মেলে। এরপর থেকেই ইরান বারবার দাবি করে আসছে, তারা কোনো পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি চালায়নি। তবে ২০১৮ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সংগৃহীত এক গোপন দলিলে স্পষ্ট হয়, ইরান পাঁচটি পারমাণবিক বোমা বানানোর পরিকল্পনা করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, ইরান ২০০৩ সালে গোপন প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে তারা কেবল ‘বেসামরিক’ পরমাণু কর্মসূচি চালানোর দাবি করে এসেছে। যদিও এটি এক ধরনের ‘থ্রেশহোল্ড’ সক্ষমতা তৈরি করেছে—যেটি চাইলে যেকোনো সময় অস্ত্রে রূপ নিতে পারে।
যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকা সক্ষমতা
ইসরায়েলের চলতি মাসের হামলায় ইরানের সব পরিচিত পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ও টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আরও তিনটি সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় হামলা চালায়। সিআইএ’র মতে, ইরানের কর্মসূচি ‘গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে।
তবুও, এখনো ইরান গোপনে পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু করতে পারে বলে মত দিয়েছেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা। কারণ—ইরানের কাছে এখনো কিছু সেন্ট্রিফিউজ, ইউরেনিয়াম ও গোপন টানেল বা অন্যান্য নিরাপদ স্থাপনা থাকতে পারে।
তবে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত বাধা হচ্ছে—ইউরেনিয়ামকে ধাতব রূপে রূপান্তরের সুবিধা। এর একমাত্র পরিচিত স্থাপনাটি ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—ইরানের কাছে কি এই ধরনের আরেকটি গোপন স্থাপনা আছে?
পারমাণবিক অস্ত্র বানানো এখন ইরানের পক্ষে কারিগরি চেয়ে বেশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। বিশেষজ্ঞ জেফরি লুইস বলেন, ‘তারা এখনো অনেক সক্ষমতা ধরে রেখেছে। প্রশ্ন হলো, তারা কি সত্যি এটি করতে চায়?’
মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক মারভিন ওয়েইনবাউম বলেন, ‘বর্তমানে ইরানের মনে হচ্ছে—নিশ্চিত অস্ত্র থাকলে আন্তর্জাতিক সমাজের আচরণ হবে ভিন্ন। তাই তাদের মনে হতে পারে, অস্ত্র তৈরি এখন অপরিহার্য।’
সমঝোতার চেষ্টা: চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসছে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ফের আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। মূল আলোচ্য—ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধের বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা। এই আলোচনার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
সূত্র: এনবিসি নিউজ।
রাকিব