
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নির্ণয়ে সে দেশের শ্রম অধিকার সংক্রান্ত বিষয়াদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময়ে পোশাক শিল্পে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপের মুখে মালিকেদের Accord প্রদত্ত গাইডলাইনস ও বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুসরণ করতে বাধ্য করা হলেও অদ্যাবধি অনেক জায়গায় এর ব্যত্যয় ঘটে চলেছে। এমনকি আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে যে সমস্ত শ্রম অধিকার রয়েছে মালিকরা তা সুকৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। মূলত মালিকদের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, পক্ষদের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সংকট, শোভন কর্মপরিবেশের অনুপস্থিতি, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডে মালিকদের বাধা প্রদান, কারখানা পর্যায়ে কালেক্টিভ বার্গেনিংয়ের অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে শ্রম আইন ও অধিকার সুনিশ্চিতসহ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক দৃঢ়তর হবে। এতে দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে, যা প্রকারান্তরে ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়নের অর্জনের পথকে সুগম করবে।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের শ্রমমান ও অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মোট ১১টি বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর তাগিদ দিয়েছেন। এগুলো হলো- ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী ও শ্রম অধিকার কর্মীদের ওপর যারা নিপীড়ন করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যে সমস্ত মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা; বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনপূর্বক আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সুনিশ্চিত করা। ইপিজেড অঞ্চলের শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ৩৪ ধারা সংশোধন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে (এসইজেড) সেটির প্রয়োগ করা। বেজা ও এসইজেডের শ্রমিকরা যাতে সংগঠিত হতে পারে ও যৌথ দরকষাকষিতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিত করা; ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের আবেদন প্রক্রিয়া ৫৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা। শ্রম অধিদপ্তরের মাধ্যমে তার বিদ্যমান নিবন্ধন পোর্টালে অপেক্ষমাণ থাকা সব ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশনের আবেদন হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ। বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ ও এর জন্য তহবিল বরাদ্দ দেওয়া; শ্রম পরিদর্শকের পদ অনুমোদন এবং নিবন্ধন বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করার অভ্যাস বন্ধ করা। শ্রম অধিকার সংক্রান্ত ইউএসটিএ কর্তৃক উল্লিখিত ১১ দফার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বিলসের নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেন, ১১ দফা বাস্তবায়নে কিছু কমিটি হয়েছে। আইন ও বিধি সংশোধনের কাজ চলছে। তবে মালিকপক্ষ যদি এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ না করে তাহলে তেমন কোনো লাভ হবে না। কারখানার অভ্যন্তরে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার যৌথ দরকষাকষির পরিবেশ তৈরি করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করা যায়।
এটা সত্য যে, মে দিবস শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনন্য মাইলফলক যা ১৮৮৬ সালে সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে শ্রম আইন ও বিধিতে অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে সরকারের অসহযোগিতা এখনো রয়ে গেছে। যে তথ্য জমা দেওয়া হয়, তা শ্রম অধিদপ্তর কর্তৃক আবার চাওয়া হয়। এমন ইনফরমেশনও চাওয়া হয় যা আইন/রুলসে উল্লেখ নেই। যেমন- ইউনিয়ন করার জন্য মালিকপক্ষের প্রত্যয়নপত্র। যে মালিক ট্রেড ইউনিয়ন হোক চান না তিনি কি প্রত্যয়নপত্র দেবেন? এমনকি, স্বাক্ষর মেলেনি এ অজুহাতেও ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন আবেদন বাতিল করা হয়। তবে এটা সত্য যে, অনেক সময় মালিক আজ্ঞাবহ পকেট ইউনিয়ন করার জন্য প্রত্যয়নপত্র দিয়ে থাকেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক শ্রম বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কোলি এম রড্রিগেজ কারখানার ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজ করা, জীবনধারণের জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত এবং শ্রমবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা-শ্রম আইনের দ্রুত সংস্কার- এ বিষয়গুলোর ওপর সমধিক জোর দিয়েছেন। ট্রেন ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিতসহ শ্রম বিরোধ নিরসনে শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগে ১৮ দফার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধদল প্রশংসা করলেও ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় এখনো সহজ না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
অনেক সময় মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে শ্রম অধিদপ্তর ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে-এ ধরনের অভিযোগ হরহামেশা পাওয়া যায়। এ বিষয়টি জানতে চাইলে শ্রমসচিব বলেন, অভিযোগটি অমূলক নয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি কারখানা ও সরকারি দপ্তর পরিদর্শন করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে কাজ চলছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে শোষণের শিকার হচ্ছে। পাচ্ছে না ন্যায্য মজুরি, শোভন কর্মপরিবেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কর্ম ঘণ্টা অনুসরণের সুযোগ। শ্রমের বিনিময়ে যে মজুরি পান তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই দুঃসময়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই দায়। অন্যদিকে দেশে বেকারত্ব একটি বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় জীবন ও জীবিকার তাগিদে শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হলেও প্রতিকূল পরিবেশ ও উদ্ধৃত শ্রমবাজার হওয়ায় সস্তা দামে ও কঠিন শর্তে শ্রমিকগণ তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মনে রাখতে হবে সমাজদেহে এ ধরনের শ্রেণি শোষণ বিদ্যমান রেখে বৈষম্যহীন সমাজ গঠন তো দূরের কথা, গণতন্ত্র ও মানবতাবোধ প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়।
এটা সত্য যে, শ্রমজীবী মানুষ আবহমানকাল থেকে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে বহু ব্যবস্থার পরিবর্তন করলেও শোষণের অবসান ঘটাতে পারেনি। বরং মালিকরা নিত্যনতুন কৌশলের মাধ্যমে শোষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে। ফলে মে দিবস সংঘটিত হওয়ার ১৩৮ বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমমান ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে সরকার, শ্রমিক, মালিকের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান ও নিবিড় যোগাযোগ অনস্বীকার্য। উপরন্তু জাতীয় চাহিদাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও শিল্পের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা বজায় রাখা, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও সার্বিক মুক্তি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে সরকারকে অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। জানিনা, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য আকাশে সেই স্বর্ণালী দিনের রঙিন সূর্য কবে উদয় হবে? যাদের শ্রমে-ঘামে কলকারখানা চলে, রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মিত হয়, ধনিক শ্রেণির বিলাস-বৈভবের নানা উপকরণ তৈরি হয়, তাদের জীবনযাত্রার মান-মর্যাদা-অধিকার প্রতিষ্ঠায় হোক- এবারের মে দিবসে এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল