ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

ইতিহাসের সত্য– সত্যের ইতিহাস

সাজ্জাদুল হাসান

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১ অক্টোবর ২০২৪

ইতিহাসের সত্য– সত্যের ইতিহাস

ইতিহাস সত্য– সত্যের ইতিহাস

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিলের ভাষ্যমতে– History is written by the victors– ইতিহাস বিজয়ীরা লেখে। কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আসলে কী? স্পষ্টত কোনো যুদ্ধে, সংগ্রামে বা দ্বন্দ্বে যারা বিজয়ী হন, তাদের দেওয়া বক্তব্য বা ঘটনার বিবরণই সাধারণত অধিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং স্থান করে নেয় ইতিহাসে। ইতিহাস তাই অনেকক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট। বিজয়ী পক্ষের অ্যাজেন্ডা এবং দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত। প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ একটু ভিন্নভাবে কথাটা বলেছেন, ‘ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে একরাশ কুৎসা।’ 
‘Until the lion learns hwo to write, every story will glorify the hunter’- যতক্ষণ না সিংহ লিখতে শিখবে, প্রতিটি গল্প শিকারিকে মহিমান্বিত করবে- এটি একটি আফ্রিকান প্রবাদ, যা ইতিহাস রচনায় বিজয়ী পক্ষের একতরফা প্রভাব এবং পক্ষপাতিত্বের ধারণাকে সমর্থন করে। স্বনামধন্য সুইডিশ ব্যান্ড অ্যাবার একটা বিখ্যাত গানের কলি– The winner takes it all; যার প্রতীকী অর্থ– দিনশেষে সবই বিজয়ীদের; বিজয়ীরা গাছেরটাও খায়, তলারটাও কুড়ায়। আর বিজিতরা? তাঁদের জন্য কবির পরামর্শ–  
অস্থির হয়ো না/শুধু প্রস্তুত হও।/এখন কান আর চোখ 
খোলা রেখে/অনেক কিছু দেখে যাওয়ার সময়।/এ সময়ে/স্থির থাকতে না পারার/মানেই হলো, আগুনে ঝাঁপ দেওয়া/তোমার কাজ 
আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়,/আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।/অস্থির হয়ো না/শুধু প্রস্তুত হও।– (‘সাগ্নিক’Ñ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
ইতিহাসজুড়ে এ রকম অসংখ্য নজির আছে যে, কীভাবে বিজয়ীরা নিজেদের স্বার্থে ঘটনার বিবরণ বেমালুম বদলে দিয়েছে। ইউরোপীয়দের দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে আদিবাসীদের নির্মমভাবে উচ্ছেদ করে উপনিবেশ স্থাপনের যে ইতিহাস লিখিত হয়েছে, তা ওপরের বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করে।

এই ইতিহাস প্রায়ই ঔপনিবেশিকরা নিজেরাই লিখেছিলেন, যাতে করে তাদের নিষ্ঠুর কর্মকা- ন্যায্যতা লাভ করে এবং মহিমান্বিত করা যায়। শোষিত জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের করুণ অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করার কারণে বেশিরভাগ ঘটনা একতরফা এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস উপনিবেশকারীদের বীর হিসাবে মহিমান্বিত করেছে, যাঁরা তাঁদের (উপনিবেশকারীদের) দৃষ্টিতে, অনগ্রসর এবং আদিম জনপদে সভ্যতা এবং প্রগতির সূচনা করেছিলেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত বর্বরতা, অবিচার এবং নৃশংসতাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে ইউরোপীয়দের দ্বারা রচিত ইতিহাসে।
একইভাবে, যুদ্ধের ক্ষেত্রে। বিজয়ীরাই যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে। যে ইতিহাসজুড়ে থাকে বিজয়ীদের অর্জন আর গৌরবগাথা। অন্যদিকে, বিজিতদের চিহ্নিত করা হয় সম্পূর্ণ নেতিবাচক ভাবে। প্রসঙ্গক্রমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মিত্র শক্তি কর্তৃক রচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে কেবল তাদের নিজস্ব বীরত্ব এবং ন্যায়পরায়ণতার ওপর অধিকতর আলোকপাত করা হয়েছে। অথচ মিত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতাকে পারতপক্ষে স্বীকার করা হয়নি।

হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তা ইতিহাসে যথাযথভাবে স্থান পায়নি। পরবর্তীতে এই ঘটনা মার্কিনীদের বীরত্বগাথা হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে, পরাজিত জাতিসমূহ দুর্বিষহ পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে, বিজয়ীদের আখ্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের নিজস্ব ইতিহাসও পুনর্লিখন করতে হয়েছিল।      
রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট ইতিহাস রচনাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। স্বৈরাচারী শাসন বা একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  ক্ষমতাসীনরা তাদের আধিপত্য এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে ঐতিহাসিক আখ্যান নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে এদিক-সেদিক করে। তারা তাদের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচার করতে এবং ভিন্নমত দমন করতে প্রয়োজনে  ইতিহাস মুছে ফেলে বা পুনর্লিখন করে। এর ফলে, সৃষ্টি হয় ইতিহাসের একটি বিকৃত সংস্করণ,  যা সত্যের প্রতিফলন না করে শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করে। যেমনটা ঘটেছিল জোসেফ স্ট্যালিনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়নে।

সোভিয়েত শাসনকে মহিমান্বিত করার জন্য এবং স্ট্যালিনকে একজন বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য ঐতিহাসিক ন্যারেটিভগুলো চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো। ভিন্নমত কঠোরহস্তে দমন করা হয়েছিল এবং ঘটনাপ্রবাহের মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছিল, যা দিনশেষে শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেছিল।  
সঙ্গতকারণেই ইতিহাসকে আমাদের সামগ্রিকভাবে অর্থাৎ, বিজয়ী এবং বিজিত– উভয় পক্ষের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা উচিত। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং একাধিক তথ্যের উৎস ঐতিহাসিক সত্য উদ্ঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্য দিয়ে যাদের কোণঠাসা করা হয়েছিল কিংবা যাদের কণ্ঠস্বর রোধ করা হয়েছিল, তাদের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গির যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

উদ্ভাসিত হবে প্রকৃত সত্য। প্রকৃত ইতিহাস রচনায় অতীতের বিকৃতি ও পক্ষপাতদুষ্টতায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঐতিহাসিক অন্যায় সংশোধনের মাধ্যমে এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিভ্রংশকে চ্যালেঞ্জ করে মানব ইতিহাস  আরও সঠিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা অত্যন্ত জরুরি।  

লেখক : একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত

×