ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৪ আগস্ট ২০২৪

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল

.

কখনো ঘাটে, কখনো মাঠে, কখনোবা স্লোগানে, কখনো নাটকের মঞ্চে, কখনো বা প্রতিবাদের তপ্ত রৌদ্রের শেষান্তে, কখনো অধিকার আদায়ের এবং মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক হিসেবে অস্ত্র হাতে, কখনোবা তরুণ প্রজন্মে মেধা রক্ষায় দক্ষ সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ কামাল১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ কামাল, যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার জ্যেষ্ঠ পুত্র১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। 

শৈশব থেকে বাবার আদর ও স্নেহের স্পর্শ বড় ছেলে শহীদ শেখ কামাল তেমন পাননিবাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে কারাগারে রাজবন্দি হিসেবেশেখ কামালের জন্মের সময়ও তিনি কারাগারেই ছিলেনএ সময় পার করে বড় হয়ে ওঠেন শেখ কামাল

শেখ কামালের শিক্ষা শুরু হয়েছিল রাজধানীর শাহীন স্কুলেএখান থেকে তিনি মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হনএরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তার সাংগঠনিক শক্তি ও ক্রীড়াপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ প্রকট আকারে প্রকাশ হতে থাকে১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণের সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেননিরহংকারী, বন্ধুবসল, সদালাপী শেখ কামালের স্পর্শ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজও লেগে আছেতার শূন্যতা হু হু হাওয়ার মতন আজও আমাদের মন ছুঁয়ে যায়

বাংলাদেশের ক্রীড়া উন্নয়নে শেখ কামাল ছিলেন অগ্রদূতখেলাধুলার প্রতি পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন শহীদ শেখ কামালতার দাদা শেখ লুফর রহমান ও পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ক্রীড়ানুরাগীশেখ কামাল নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও বাস্কেটবল খেলায় অংশগ্রহণ করতেনশাহীন স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি এই ক্রীড়া জগতের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃদল ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেনফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল দলের ক্যাপ্টেনও ছিলেন তিনিতার দল ছিল অপরাজেয়

শেখ কামাল ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়া সংগঠন, বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেতবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হনদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ কামাল বন্ধুদের নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় গড়ে তোলেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রআবাহনী ক্রীড়াচক্র আজ দেশ-বিদেশে পরিচিত একটি ক্লাবই নয়, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আধুনিকায়নের পথিকৃ প্রতিষ্ঠান হিসেবেও খ্যাতিমানক্লাব ভবন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই শেখ কামাল আধুনিকতার নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন

বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার শেখ কামালের বন্ধু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং সাফ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির দৃঢ় বিশ্বাস, আজ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলতএশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশে পরিণত হতো বাংলাদেশবাংলাদেশের ক্রিকেটকে এখন সবাই সমীহ করেবলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন পরাশক্তিওয়ানডেতে এখন সত্যিই সমীহ করার মতো খেলছে টাইগার বাহিনীযুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ড গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন শেখ কামালঅনেকে বলেছিলেন, ক্রিকেট রাজকীয় খেলা, এ খেলায় অনেক ব্যয়এ দেশের ছেলেরা এত টাকা ব্যয় করে ক্রিকেটসামগ্রী কিনতেও পারবে নাএ খেলার প্রসারও ঘটবে নাবহুমাত্রিক অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী তারুণ্যের প্রতীক শহীদ শেখ কামাল সেদিন সমালোচকদের কথায় কান দেননিফুটবলের মতো ক্রিকেটের প্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ ক্রিকেট বিশ্বে ধীরে ধীরে পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছেহকিতেও নতুন দিনের সূচনা করেছিলেন শেখ কামালযোগ্যতা, দক্ষতা আর দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফুরণে এই মানুষটা বদলে দিচ্ছিলেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশের পুরো ক্রীড়াক্ষেত্র। 

মঞ্চনাটকেও স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন শেখ কামালস্বাধীনতার পরে দেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে এক উল্লেযোগ্য অগ্রগতি ঘটেবাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাপদ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে সমাজচেতনায় উদ্বুদ্ধ নাট্যকর্মীরা এগিয়ে আসেনশেখ কামাল যুক্ত ছিলেন তাতেস্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির সংগঠকএখনকার বিখ্যাত নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ কামালনিয়মিত অভিনয়ও করেছেন মঞ্চেঅভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে যুক্ত ছিলেনকলকাতাতেও নাটকের দল নিয়ে গেছেন, সেখানে প্রশংসিত হয়েছেন অভিনয় করে

তার বড় বোন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে খুব আদর করতেন এবং পিঠাপিঠি হওয়ায় নিজেদের মধ্যে ছিল সুসম্পর্কছোট ভাই বড় বোনের কাছে এডিডাসবুটও চেয়েছিলেন, যেটা প্রধানমন্ত্রী তাকে দিয়েছিলেনতিনি আবাহনীর স্রষ্টা, তিনি ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রেখেছেন এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁর এমন সম্পর্ক ছিল যে, ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন করে গড়ে তোলায় অবদান রাখেনতিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৯ সালে১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে ব্যাপক ভূমিকা রাখেনবিপুল প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক তরুণ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শহিদ শেখ কামালবীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক, ধ্রুপদি সংগীত ও নাট্যশিল্পী, সংস্কৃতি সংগঠক, ছাত্রনেতা  এমন অনেকভাবেই তার পরিচয় দেওয়া যায়তবে দুঃখজনক হলো, শেখ কামালের প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনিবলা সংগত যে, সেজন্য যথেষ্ট সময় তাকে দেওয়া হয়নিমাত্র ২৬ বছর বয়সে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়তার বিদেহী আত্মার প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই

লেখক : অধ্যাপক, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়; ও সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন

 

 

×