.
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দুইদিনের বাংলাদেশ সফর শেষে ১৬ মে ঢাকা ত্যাগ করেন। যদিও এটি তার রুটিন সফর তবুও লু’র বাংলাদেশ সফর নিয়ে ঢাকার রাজনীতিতে খানিকটা উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের তৎপরতা বহুল আলোচিত। সম্প্রতি ডোনাল্ড লু’র ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে দুটি রাজনৈতিক দলের কথার লড়াই বেশ জমে উঠেছে। ডোনাল্ড লু চলে গেলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘লু’ হাওয়া আরও কয়েকদিন বইবে। বিশেষত লু’র সফরের পর নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে যায় সেটির বিষয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা পালন করবে, যেমনটা তারা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করে থাকে। নিজ দেশের স্বার্থের পরিপন্থি মনে করলে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো রাষ্ট্রে, বিশেষত রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত দেশে সরকার পরিবর্তনে যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পিছপা হয় না, সে কথা এখন সকলেরই জানা। নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন (রাজনৈতিক) তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করে নির্বাচন থেকে বিরত থেকে বিএনপির অর্জন কতটুকু হলো তা ইতিহাসই বলবে। তবে এটি যে বিএনপির একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল তা বোঝার জন্য বড় মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। বিএনপির এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আওয়ামী লীগ বারবারই ওয়াকওভার পেয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপিকে এই ভুলের খেসারত বহুদিন ধরে দিতে হবে। অন্তত আগামী পাঁচ বছর যে এর মূল্য দেবে তা বলাই যায়। আগামী নির্বাচনেও কী একই ভুলের পুনরাবৃতি ঘটবেÑ সেটি সময়ই বলে দেবে। কেননা, বিগত তিনটি নির্বাচনে বিএনপি একই ভুলের চক্করে আবর্তিত হয়েছে। ভুলের এই দুষ্টুচক্র থেকে বিএনপি আদৌ বের হতে পারবে কি না তা বলা মুশকিল। কেননা, ‘কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বিএনপির জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে রেখেছে’। বহু ধারায় বিভক্ত বিএনপির নেতাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই নেই। বিএনপির নেতারা যেদিন স্বাধীনভাবে ‘দেশজ’ পরিস্থিতির নিরিখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যথেষ্ট সাবালক হবেন সেদিন বিএনপির রাজনীতি পশ্চিম নির্ভরতা থেকে মাঠনির্ভর হবে। বিএনপি নিজের খুঁটির ওপর আস্থা না রেখে অন্যের ওপর ভরসা করতে গিয়ে এ-কূল ও-কূল দুই কূলই হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিভিন্ন প্রফেশনাল লবির দ্বারা প্রভাবিত হয় সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মার্কিন সমর্থন আদায়ের জন্য বিএনপি বহু অর্থ বিনিয়োগ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল তা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিএনপিও সেসব অস্বীকার করেনি। বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতি, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি প্রয়োগসহ বিভিন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল।
আর কূটনীতির আড়ালে পিটার হাসের রাজনৈতিক তৎপরতা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। জাপান আমাদের দেশে বড় বিনিয়োগকারী। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করতে তাদের দেখা যায় না। ঘনঘন পশ্চিমা কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সফর এবং বিভিন্ন ধরনের অযাচিত বক্তব্যের কারণ একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের তৎপরতায় একপক্ষ খুশি হলেও অন্যপক্ষ বেজার হয়। বিগত সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুবিধা স্থগিত, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান, ভিসানীতি প্রয়োগ ইত্যাদি পদক্ষেপে একটি রাজনৈতিক দল খুশি হয়েছিল। অন্যদিকে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। অথচ বাংলাদেশে র্যাবের ওপর যে সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল তাতে মনে হয়েছে সেটি একটি ভুল সময় ছিল। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তৎকালীন বিএনপি সরকার যখন র্যাব গঠন করেছিল তখন র্যাব বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে একটি আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল বিএনপি রাজনীতিতে ত্রাস সৃষ্টি করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সহায়ক শক্তি হিসেবে গঠন করেছিল র্যাব। সে সময়ে একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে র্যাবের ক্রসফায়ার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য শোনা যায়নি। আবার গার্মেন্টস পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বন্ধ করে বাংলাদেশ সরকারকে শায়েস্তা করতে গিয়ে বরং শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ভিসানীতি বড় বড় দুর্নীতিবাজদের সে দেশে যাওয়া বন্ধ করতে পারেনি।
ডোনাল্ড লু সংবাদ ব্রিফিং-এ স্বীকার করেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তারা সেসব ‘অস্বস্তি ভুলে পেছনে নয়- সামনের দিকে তাকাতে চায়।’ ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে।’ এত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও তারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারেনি, ক্ষমতায় যাওয়া তো পরের কথা। সেটি তাদের ব্যর্থতা, নাকি বিএনপির ভুল তা জানার আগ্রহ রয়েছে মানুষের। তবে একটা বিষয় সকলের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছেÑ লু এবং হাস এত ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যেও বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সময় পেলেও বিএনপির নেতাদের সাক্ষাৎ দিতে পারলেন না কেন? অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, ‘ব্যস্ত সময়সূচির কারণে পারেননি।’ অনেকে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র অলাভজনক জায়গায় ‘ইনভেস্ট’ করে না। তারা আফগানিস্তানে আশরাফ ঘানিকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বন্ধুত্বের প্রতি ন্যূনতম প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। ঘানি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমেরিকাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল ছিল।’
যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল বিএনপির মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে পারলে দুর্বল সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তারা একটি প্রভাববলয় তৈরি করতে পারবে। এটি তাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। বঙ্গবন্ধু এ ধরনের সুযোগ দিতে রাজি না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দুর্বল রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনতে পারলে সে ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে তারা আশা করেছিল। যখন হয়নি তখন বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে তারা জোর দেবে সেটাই স্বাভাবিক। আর বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহযোগিতা অগ্রাহ্য করবে না। ডোনাল্ড লু’র সংবাদ ব্রিফিং গুরুত্বসহকারে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি খোলামেলাই বলেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরষ্ট্র সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে চায়। তারা আর পেছন ফিরে তাকাতে চায় না।
তার মানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুর আপাত সমাপ্তি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি লেখেন সেখানেও পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থন এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সমুদ্র রাজনীতিতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। সেটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিঠিতেও প্রতিভাত। আর এবারের সফরকালে লু বলেন, ‘গত বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক উত্তেজনা ছিল।’ এ ধরনের একটি স্বীকারোক্তি তারা প্রথমবার করলেন। তিনি বলেন, ‘এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। এখন আমরা নতুন একটি অধ্যায় প্রত্যাশা করছি।’ এখন প্রশ্ন হলো তারা কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন হতে সহয়তা করল, নাকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন একটি নির্বাচনে সহায়তা করল! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তো মনে করেন তারা হস্তক্ষেপ না করলে বিএনপি নির্বাচনে আসত। যা হোক, লু’র কথায় বিএনপির জন্য হতাশা ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিবের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। একবার বলেন, ‘ডোনাল্ড লু’র সফর সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।’ অন্যদিকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থানেই রয়েছে। বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম ডোনাল্ড লু’র সফর গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে ধারণা করা যায় বিএনপি খানিকটা হতাশ। বিএনপির হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পথে নামিয়ে চলে গেছে।
সকলের মনে থাকার কথা- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠ গোছানোর কৌশল নিয়ে ব্যস্ত আর বিএনপি পশ্চিমা হাওয়ার অপেক্ষায় দিন গোনে। যখনই পশ্চিম দিক থেকে ‘লু হাওয়া আসত অমনি বিএনপি শিবিরে মৌসুমি বৃষ্টির সম্ভাবনায় খুশির জোয়ার বয়ে যেত। আর আওয়ামী লীগ মরুর ‘লু’ হাওয়া প্রতিরোধে সমস্ত ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করত। বিএনপির রাজনৈতিক মাঠে মৌসুমি বৃষ্টি হয়নি। ফসলও ফলেনি। উল্টো ফসল ঘরে তুলেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতারা পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি আশ্বাস বাণীর জন্য কত যে উদ্্গ্রীব ছিলেন তা গণমাধ্যমে এখনো ঘুরে ফিরছে। অথচ একি কথা শুনি এখন তাদের মুখে! তাদের সফরের গুরুত্বই নাকি বিএনপির কাছে নেই। বাংলার ইতিহাসে এরকম স্বার্থবাদী রাজনৈতিক চরিত্র নতুন কিছু নয়।
পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের বিষয়ে ব্রিটিশ সংসদে একটি শুনানিকালে খলনায়ক লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন, ‘পলাশীর পতনের পর মুর্শিদাবাদের বাঘা বাঘা অভিজাতরা আমার মুখের এক চিলতে হাসির জন্য কী অধীর আগ্রহে বসে থাকত তা যদি আপনি দেখতেন মাই লর্ড।’ বিদেশী শক্তির সঙ্গে মিলে এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নিজের আত্মশক্তি আর দেশের জনগণের ওপর ভরসা রেখে জীবন দিয়েও দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা আজও ইতিহাসে বীররূপে মানুষের অন্তরে সুরক্ষিত। আর দেশের স্বার্থ ধ্বংস করে যারা বিদেশী শক্তির পূজারি হয়েছিল সেই মীর জাফররা খলনায়করূপেই ধীকৃত। রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা পরিহার করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে জনগণের শক্তির ওপর ভরসা রেখে দেশের স্বার্থরক্ষায় কাজ করলে জনগণ তার মূল্যায়ন করবেই। সকল রাজনৈতিক দল আর রাজনীতিকদের জন্যই কথাটা সত্য।
লেখক : অধ্যাপক ও প্রাধ্যক্ষ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়