ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

ঢাকার দিনরাত

বৃষ্টি মানেই নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট

বৃষ্টি মানেই নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট। অগ্রহায়ণে পরপর দু’দিন ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে বৃষ্টি। শীত নামানোরই অনুষঙ্গ যেন। সংবাদপত্রের ছবিতে হিমহিম আবহাওয়ায় বৃষ্টির ভেতর বয়স্ক রিক্স্যাভান চালক নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন পলিথিনে। শুয়ে আছেন মগবাজার মৌচাক উড়াল সড়কের নিচে। সেখানে খানিকটা সুরক্ষা পেয়েছেন বৃষ্টির ছাট থেকে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছবি প্রকাশিত হলে আমাদের চোখ আটকে যায়; কিছুক্ষণ আমাদের মন বিষাদাক্রান্ত থাকে। তারপর সব ভুলে যাওয়া। গভীর রাতে আমরা ঘরেই থাকি। যদি প্রয়োজনে বেরুতেই হয়, আর ফুটপাথে নজর বুলোই, তবে এক-দু’জন ফুটপাথবাসীর দেখা আমরা পেয়ে যাই।

অথচ চোখে দেখেও তা ঠিক বিশ^াস করতে চাই না। এটা ঠিক যে নানা সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের কারণে নিম্ন আয়ের বহু মানুষই উপকৃত হয়েছেন, তবু সত্যপ্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতেই হবে যে, এখনও এই ঢাকা মহানগরীতে ফুটপাথে, উড়াল সড়কের নিচে, রেলস্টেশনের মেঝেতে গৃহহীন মানুষ রাত্রিবাস করে। প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় নিঃস্ব মানুষ আসেন। তাদের থাকার জায়গা কোথায়?

ক্রেনের আঘাতে ট্রেন
রাজধানীর তেজগাঁও রেলওয়ে এলাকায় বৃহস্পতিবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের ক্রেনের আঘাতে একটি ট্রেনের ইঞ্জিন ও একটি বগি লাইনচ্যুত হলে ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের ট্রেন চলাচল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এ ঘটনায় অবশ্য কোনো প্রাণহানি হয়নি। পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রীদের। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়লে ঘটনাস্থলে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল। কারও না কারও উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে ক্রেন-ট্রেনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। বড় ক্ষতি হতে পারতো। এটি থেকে সংশ্লিষ্টদের শিক্ষা নিয়ে আরও সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

ব্যতিক্রমী ডিসেম্বর
ডিসেম্বরে ঢাকায় প্রতিবছরই প্রচুর সাংস্কৃতিক উৎসব/অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করেও হয় বিচিত্র অনুষ্ঠান। এবারই ব্যতিক্রম। গান ও চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা নাট্যসপ্তাহও হলো না। গত বছরে ডিসেম্বরে ছিল বিশ^কাপ ফুটবল। মধ্যরাতে থাকত খেলা। শীতের বিচিত্র উৎসবে বিশ^কাপ ফুটবল আরেকটি বড় উৎসবের উপলক্ষ হয়েছিল। ঢাকায় বড় পর্দায় যেখানেই খেলা দেখানো হয়েছে সেখানেই মানুষ দল বেঁধে খেলা দেখেছেন। এমন ম্যাচ অনেকেই ঘরে না দেখে বড় পর্দায় দেখার জন্য পাবলিক প্লেস কিংবা রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবে চলে গেছেন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে, বলা ভালো, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের মধ্যে থেকে এমন খেলা উপভোগ ভিন্ন মাত্রা পায়।

যা হোক, অনেকেই হয়তো বলবেন, ডিসেম্বরে অনুষ্ঠান/উৎসব নেই অবরোধের কারণে। কিন্তু অবরোধে সব কিছুই তো স্বাভাবিক আছে। অন্তত ঢাকার ভেতরে। দূরপাল্লার বাস কম চলছে, এছাড়া সবই যখন ঠিক আছে তখন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে ভাটা কেন? হয়তো মানুষের মনে শঙ্কা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং আসন্ন নির্বাচনÑ সব মিলিয়ে উৎসবের মনটা নেই। হতে পারে অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজকরা ভাবছেন উদ্যোগ নিলে যদি অনুষ্ঠান সফল না হয়। তবে এমন ডিসেম্বর ঢাকাবাসীর কাছে কিছুটা খাপছাড়াই। 

লেখকদের আনন্দ ভ্রমণ
নদীপথে বইমেলা এবং লেখক ও লেখক-বন্ধুদের আনন্দ ভ্রমণ। প্রায় ৩০০ জনের আনন্দসমাবেশ। শীত শুরু না হতেই এ এক মনোরম মজাদার যাত্রা। এটিকে লেখকদের পিকনিকও বলা চলে। আবার নৌভ্রমণও বলা যায়। দল বেঁধে কবি-সাহিত্যিকরা ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন, তিন দিন আনন্দ করে ফের ফিরে এলেন ঢাকায়। এর মাধ্যমে লেখকে-লেখকে যেমন সরসারি আলাপনে এক ধরনের নৈকট্য লাভ ঘটে, তেমনি পরবর্তীকালে লেখার প্রেরণা ও রসদও মেলে। অপরিচিত লেখককে চেনাজানারও সুযোগ বটে। তরুণ ও প্রবীণ কবি উভয়ে নিজের কণ্ঠে কবিতা শোনানোর সুযোগটিও কাজে লাগান। বিষয়টি কিছুটা অভিনব, মানতেই হবে। হাসি, গান, কবিতা, রসিকতা, আড্ডায় নিঃসন্দেহে প্রাণের স্ফুর্তি প্রকাশ পায়। কবি সৈয়দ তারিক ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা লিখলেনÑ  ‘ভ্রমণ শেষে ঢাকার পথে ফিরছে এখন শুভরাজ-৯। চেনা-নাম জানা-অচেনা নারী ও পুরুষ লেখকগণের সান্নিধ্যে ভ্রমণ-আহার-আড্ডা-গানবাজনায় চমৎকার কাটল সময়।’ লেখক-সাংবাদিক আনিস আলমগীর অন্যভাবে তুলে ধরলেন ভ্রমণের গল্প- ‘এখন মধ্যরাত। আমাদের জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে ভোলা জেলার চরকুকরি মুকরির দিকে। স্থানীয়রা এই দ্বীপ বা চরকে ‘দ্বীপকন্যা’ নামে ডাকে। ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা দ্বীপটিতে বেড়াব শুক্রবার সারাদিন।’

কবি আবদুর রব লিখেছেন: ‘লোক সম্পাদক অনিকেত শামীম, কথাশিল্পী পারভেজ  হোসেন ও তাদের সহকর্মীদের সেবায় সবাই আমরা ছিলাম জামাই আদরে। সবকিছু ছাপিয়ে দিনে-রাতে বারবার রেলিং-এ দাঁড়িয়ে নদীর উপর দিয়ে বয়ে চলা শীতল বাতাস নিই বুক ভরে। দমবন্ধ জীবন থেকে একটু বেরিয়ে আসার এমন সুযোগ আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস আমরা যারা একই তরণীর যাত্রী তাদের সবারই এই অনুভূতি হয়েছে। নদীতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত যে অনুভূতি হয়! দেখি বিভিন্ন জলযান বিভিন্নভাবে অদ্ভুত সব বার্তা দিচ্ছে। দেখলাম ছোট্ট একটা নৌকায় অনেকগুলো রঙিন পতাকা উড়ছে। আর লোকগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন বলছে চল চল জীবিকার টানে এগিয়ে যাই।

ছোটো ছোটো নৌকাগুলিরও আছে নিজস্ব গল্প। একটা নৌকা জাল নামাচ্ছে মাছ ধরবে বলে। জাল ফেলা হয়ে গেলে অপেক্ষার পালা। এক নায়ে তিন মাঝি। তারা রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘাটে বাঁধা আরেকটা নৌকা। যেন তার মালিক রাত জেগে মাছ ধরে বাড়িতে ফিরে ঘুমোচ্ছে। সেই ফাঁকে নৌকাটাও দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে কেওড়া গাছের ছায়ায়। পৃথিবীর কত দেশ ঘুরেছি। কিন্তু নিজের দেশের এইসব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দুচোখ ভিজে যায় এক অনাবিল মুগ্ধতায়।’ 

হলফনামা নিয়ে কথামালা
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থীদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এ হলফনামার তথ্য সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব হলফনামা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে। কোনো কোনো প্রার্থীর সম্পদ দ্বিগুণ বাড়লেও তার স্ত্রী ও সন্তানের সম্পদ রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো অবস্থা। যাহোক, বিগত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন জুনাইদ আহমেদ। তিনি মন্ত্রিসভারও সদস্য হন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। তার হলফনামার তথ্য দিতে গিয়ে একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে, সম্পদ-আয় দুটোই বেড়েছে প্রতিমন্ত্রী পলকের।

আরেকটি পত্রিকার শিরোনামÑ জুনাইদ প্রায় শূন্য থেকে কোটিপতি। বলাবাহুল্য শেষোক্ত শিরোনাম পাঠকদের কৌতূহল জাগাবে ঠিকই কিন্তু এমন শিরোনামের পেছনে উদ্দেশ্যটিও স্পষ্ট হয়ে যায়। পরোক্ষ নিন্দা প্রকাশের ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু না পেয়ে আরেকজন প্রার্থী সম্পর্কে বলা হচ্ছে তিনি কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার ব্যক্তির শখ, সামর্থ্য, কমফোর্ট ও রুচির বিষয়। সেটা কি সংবাদ শিরোনাম হতে পারে! ভাগ্যিশ এখন পর্যন্ত কেউ লেখেননি প্রার্থীর পরিহিত স্যুট কিংবা শাড়ির দাম ৫০ হাজার টাকা। 

মীরপুরে হার ও প্রতিক্রিয়া
নানা কারণেই নিউজ্যিলান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুশফিক অভিনবভাবে আউট হয়েছেন হাত দিয়ে বল ধরার কারণে। এ নিয়ে একটি টিভি চ্যানেল আরও অভিনব অগ্রহণযোগ্য ইঙ্গিত দিলে মুশফিক কড়া আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন তাদের। মুশফিকের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খানের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজ চলাকালীন গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ‘আউট অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’-কে কেন্দ্র করে ‘মিরপুর টেস্টে স্পট ফিক্সিংয়ের গন্ধ!

সন্দেহ সিনিয়র ক্রিকেটারের দিকে!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ৭১ টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান খেলাযোগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে প্রচার করা হয়। প্রতিবেদনে মুশফিকের আউট নিয়ে মনগড়া, অসত্য, উদ্দেশ্য-প্রণোদিত তথ্য পরিবেশন করে তার দীর্ঘ ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ওপর কালিমা লেপন করা হয়েছে এবং তার সুনাম ক্ষুণœ করা হয়েছে। 
আরেকটা দিক হলো, নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক টিম সাউদি এমন একটি অভিমত দিয়েছেন যাতে আমরা লজ্জিতই হয়েছি। তিনি বলেছেন, ‘আমার ক্যারিয়ারে দেখা সবচেয়ে বাজে উইকেট’। হেরে যাওয়ার পরে এমন একটা কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। ঢাকার মিরপুর টেস্ট জিততে পারেনি বাংলাদেশ। চতুর্থ দিনে এসে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরেছে ৪ উইকেটে। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটে এই টেস্ট শুরুর পর প্রথম দিনের খেলা শেষে অনেকেই তখন বলাবলি করেছেন, ম্যাচটা দুই দিনে শেষ হয়ে যেতে পারে! কারণ, প্রথম দিনেই পড়েছিল মোট ১৫ উইকেট।

দুই দল মিলে রান তুলতে পেরেছিল মাত্র ২২৭। খেলা হয়েছে মোট ৭৯ ওভার, এর মধ্যে দুই দল মিলিয়ে দেড় ইনিংস নেই! বাংলাদেশ অলআউট হওয়ার পর ৫ উইকেট হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। প্রথম দিনেই এমন চিত্রের পর টেস্ট দুই দিনেই শেষ হতে পারতো। সেই টেস্ট চতুর্থ দিনে গড়ালেও খেলা কিন্তু চার দিন হয়নি। দ্বিতীয় দিন ভেসে যায় বৃষ্টিতে। 

রাজাধিরাজ পেঁয়াজ! 
হুট করে মহাদামী হয়ে গেল পেঁয়াজ। একদিনে পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা বাড়ে কীভাবে, প্রশ্নটি বাণিজ্য সচিবের। আসলে এ প্রশ্ন ঢাকার প্রতিটি পরিবারেরই। বাণিজ্য সচিব বললেন, ‘ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করল আর দেশে একদিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেল! এটা ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল আচরণ নয়।’
বাংলাদেশ এখন পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। শীতের বাজারে ইতোমধ্যে পাতাসহ নতুন পেঁয়াজ এসেছে। এ মাসেই বাজারে আসবে চার-পাঁচ লাখ টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ। মার্চ মাসে আসবে ৩৫ লাখ টন চৈতালি পেঁয়াজ। তবু মানুষের কী এক উৎকণ্ঠা ও হুজুগ পেঁয়াজ নিয়ে! রাতারাতি কিনেই ফেলতে হবে! ব্যবসায়ীদেরও পোয়াবারো। সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। প্রশাসন ব্যাপকহারে জরিমানাও শুরু করে দিল। মূল হোতাদের ধরে জেলে দিতে পারলে হয়তো তাদের সম্বিৎ ফিরতো। মানুষকে জিম্মি করে এমন অপকর্ম করা মোটেই ঠিক নয়, এটা বুঝতে পারতো। 


১২ ডিসেম্বর, ২০২৩
[email protected]

×