.
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে যখন আমি বিছানায় যাই তখন মনে হয়েছিল যুদ্ধ শেষ। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে ৩ ডিসেম্বর শুরু হওয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমার বাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে আগে থেকেই নিয়োজিত ছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমাগম ঘটবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেও দায়িত্ব পালন করছিল। আমরা নিরাপত্তা নিñিদ্র করতে যা করা সম্ভব তাই করেছিলাম। তথাপি আমাদের ভাগ্যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিল।
১৭ ডিসেম্বর যখন আমি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্নিরীক্ষণ করছিলাম তখন আমার CO (Commanding Officer) লে. কর্নেল ভি এন চান্না খুব দ্রুত তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তখন সকাল ৯টা। আমি মনে করেছিলাম অভ্যাগত গুরুত্বপূর্ণ যারা তখন ঢাকা ছাড়ছিলেন তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ের ব্যাপারেই আমাকে ডাকা হয়েছে। আমি মিটিংয়ে উপস্থিত হতে রওনা করলাম । আমি যখন সেখানে উপস্থিত হলাম তখন চান্নাকে বিষদাক্রান্ত বলে মনে হলো। কোনো ভূমিকার অবতারণা না করেই তিনি সরাসরি বিষয়টি উত্থাপন করলেন। তিনি আমাকে রহস্যপূর্ণভাবে বললেন, ‘আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।’ তিনি আরও বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পাহারায় রয়েছে এবং আমাকে তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে তিনি আদেশ করলেন।
তথ্যটি মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধার (বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিফৌজের একজন যোদ্ধা) এবং বিশ্বাসযোগ্য। অবস্থাটি মর্মস্পর্শী এবং কারাবন্দি পরিবারের সদস্যদের জীবনের হুমকি মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধাকে আমার পথপ্রদর্শক হিসেবে এবং দুজন গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে আমি দ্রুত গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দিলাম। বাংলাদেশের সর্বাগ্রগণ্য পরিবারকে যেখানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে তার থেকে ১০০ গজ দূরে কিছু স্থানীয় লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। তারা জানাল যে, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়িটি পাহারা দিচ্ছে। কাছেই দাঁড়ানো বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা একটি গাড়ি এবং রক্তে ভাসমান একটি মৃতদেহের দিকে তারা অঙ্গুলি নির্দেশ করল। তারা অনুনয় করতে লাগল, ‘সাবধান, সৈন্যরা কোনো কারণ ছাড়াই গুলিবর্ষণ করছে।’
ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বালুর বস্তার আড়ালে যেসব শত্রুসৈন্য রয়েছে তাদের মোকাবিলায় আমি মাত্র চারজন লোক নিয়ে উদ্ধার কাজে অগ্রসর হলাম। তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা ছিলাম অজ্ঞ। সামনাসামনি যুদ্ধ করা বোকামি হবে। কিন্তু বাড়িটিতে প্রবেশের আর কোনো রাস্তা ছিল না। যেভাবেই হোক কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এবং খুব দ্রুত। অবচেতনভাবে আমি স্থির করলাম, মানসিকভাবে মোকাবিলা করে শত্রু সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু সময়ের মূল্য আছে এবং অন্য পন্থা অবলম্বনের সুযোগ নেই।
আমরা যখন গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি এলাম তখন একজন সৈন্যকে আমার বন্দুকটি দিয়ে দিলাম এবং তাদের বললাম স্থানীয় লোকদের সঙ্গে সেখানে থাকতে। অস্ত্রহীন হয়ে আমি ধীরগতিতে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দিলাম। বুলেটবিদ্ধ গাড়িটির কাছে পৌঁছে আমি আমার পাকিস্তানি প্রতিপক্ষের প্রশংসা করে তাদের সম্বোধন করলাম। আমি চিৎকার করলাম, ‘এখানে কেউ আছেন।’ কোনো উত্তর এলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হলাম। ‘থামো, নতুবা আমি তোমাকে গুলি করব–’ একজন পাকিস্তানি সৈন্য বাড়ির ছাদের ওপর থেকে পাঞ্জাবি ভাষায় চিৎকার করে উঠল।
আমি বাড়ির প্রধান ফটক থেকে দশ গজ দূরে অবস্থান করছিলাম। বন্দুকের একটি ট্রিগারের ওপর আমার জীবন-মরণ নির্ভর করছিল। সে কারণে অবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে আমি সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলাম।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু একই সেনাবাহিনীর সৈন্যরা এখানে রয়েছে এবং তাদের হাতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার পরিবার গৃহবন্দি। তদুপরি তাদের সৈন্যদের অস্ত্র আছে, যা তারা আমার ওপর পরীক্ষা করতে পারে ।
আমি সৈন্যটির দিকে তাকালাম এবং ঘটনাক্রমে পাঞ্জাবি ভাষা বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলাম। কথা বললাম। আমি মাপা আওয়াজে, কিন্তু পূর্ণ ক্ষমতার সঙ্গে সৈন্যটিকে বললাম, ‘আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার, যে অস্ত্রহীন অবস্থায় তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’ যুদ্ধ শেষ। তোমার সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে এবং আমি আদেশ করছি তুমি তোমার অস্ত্র নামাও।’
পাকিস্তানি সৈন্যটি বিভ্রান্ত হয়েছে বলে মনে হলো। একটি উদ্বেগজনক নীরবতা নেমে এলো। মনে হলো এই নীরবতা আজীবনের। হঠাৎ আকস্মিকভাবে, সেই মুহূর্তে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
আমি বললাম, ‘ওই হেলিকপ্টারটি দেখ। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। আমি আবার বলছি, তোমার সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। তোমার অস্ত্র নামাও।’ শত্রুপক্ষের সৈন্যটি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল এবং সে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে সময় নিল।
আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। তোমার সব অফিসার যুদ্ধবন্দি এবং যোগাযোগের সমস্ত পথ বন্ধ।’ এ সময়ের মধ্যে বাড়িটির সদর দরজায় অবস্থানরত শত্রু সৈন্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ একজন মহিলার উচ্চৈস্বরে আর্তনাদ নীরবতা ভঙ্গ করল– ‘যদি আপনি আমাদের রক্ষা না করেন... তাহলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে ।’
পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি যে ভয়টি করছিলাম তা বদ্ধমূল হলো। শত্রুকে তাদের বিকল্প পন্থা চিন্তা করার সময় না দেওয়ার কথা বিবেচনা করে আমি দ্রুতবেগে সদর দরজায় অবস্থানরত যুবক সৈন্যটির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি আরেক কদম অগ্রসর হলাম এবং ডান কাঁধের ওপর বন্দুকের ঠান্ডা ধাতব অংশের স্পর্শ অনুভব করলাম। সে তার কাঁপা হাত এবং আঙুল দিয়ে বন্দুকের ট্রিগারে হাত দিয়ে আছে। এ ঘটনাটি আমি যে অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থানে ছিলাম তা স্মরণ করিয়ে দিল। এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, সে কখনো তার শত্রুর সঙ্গে এত কাছ থেকে মোকাবিলা করেনি।
আমি সৈন্যটির চোখের দিকে তাকালাম। আমি তাকে নম্রভাবে বললাম, ‘তোমার সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধ শেষ।’ তারপর আমি আস্তে করে আমার শরীর থেকে ধাতব অংশটি সরালাম। জানতাম আমি তাকে যে বার্তা দিয়েছি তা তার মধ্যে কাজ করছিল। সুতরাং আমি শেষবারের মতো আমার ট্রাম্প কার্ডটি আবেগঘনভাবে হঠাৎ করেই পেশ করলাম।
আমি বললাম, ‘তোমার পরিবার তোমার নিরাপদ ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তোমাকে নিরাপদে ফেরত পাঠাতে বদ্ধপরিকর। আমার কাছে আত্মসমর্পণ করো এবং আমি তোমাকে নিরাপত্তা ও নিরাপদে তোমার বাড়িতে ফেরত যাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছি। তুমি যদি আত্মসমপর্ণ না করো, তাহলে মুক্তিবাহিনী যোদ্ধার হাতে তোমার মৃত্যু অবধারিত।’ আমি তার প্রতিক্রিয়ার জন্য থামলাম, তারপর কঠিন স্বরে বললাম, ‘এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও... তুমি মুক্তি চাও... নাকি ধীরগতির নৃশংস মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে ।’
শত্রুপক্ষ প্রতিরোধ করা থেকে বিরত থাকল এবং আত্মসমর্পণ করল। ইতোমধ্যে আমি দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম এবং দরজা খুলে বাংলাদেশের সর্বাগ্রগণ্য পরিবারকে নিরাপদ করলাম। সম্ভাব্য যে কোনোরকম উস্কানিমূলক ঘটনা রহিত করলাম। বেগম মুজিবুর রহমান হাঁফ ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ও কিছু আত্মীয়স্বজন ছিলেন। বন্দিত্বের অবস্থা শেষ হলো। ডজনখানেক পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দি করা হলো।
বেগম মুজিব আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘ভগবান আপনাকে আমাদের রক্ষা করার জন্য পাঠিয়েছে... আপনি আমার ছেলের মতো।’
‘আমি চাই আপনি থাকুন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন ।’
বাংলাদেশের সর্বাগ্রগণ্য পরিবারের মুক্তির পর জনাব খোকা (পরিবারের একজন আত্মীয়) বিল্ডিংটির ছাদে উড়ন্ত পাকিস্তানি পতাকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তৎক্ষণাৎ আমি ওপরে উঠলাম এবং পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে বাংলাদেশী পতাকা লাগালাম। বেগম মুজিবুর রহমান তাঁর পা দিয়ে পাকিস্তানি পতাকাটা মাড়ালেন এবং উচ্চৈস্বরে বলে উঠলেন, ‘জয় বাংলা।’ সে সময় সেখানে যে জনতার সমাগম হয়েছিল তারা সর্বাগ্রগণ্য পরিবারটির প্রতি হর্ষধ্বনি করল এবং জয় বাংলা ধ্বনি দিল।
বঙ্গবন্ধু তখনও ঢাকায় ফেরত আসেননি, কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের একটি সুযোগ পেলাম। তিনি তাঁর পরিবারকে রক্ষার জন্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রায় ৪১ বছর পর, ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর শেখ হাসিনার নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সরকার আমাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু স্মারক’ সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য চার দশক আগে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তারপর এই অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী।
অনুবাদ : সুমনা লতিফ
লেখক : ভারতীয় সেনাবাহিনীর
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা