ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

স্মরণ ॥ দেশপ্রেমিক নেতা মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

মোহা. হাবিবুল ইসলাম সুমন

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

স্মরণ ॥ দেশপ্রেমিক নেতা মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত সফল মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সফল সভাপতি। ১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মোহাম্মদ হানিফের জন্ম। তিনি পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে। হানিফ দম্পতির এক পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। পুত্র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত পূর্ণ মন্ত্রী মর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।

মোহাম্মদ হানিফ যৌবন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তার জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিল সজ্জন ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ খ্যাত যিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নির্বাচিত একজন সফল মেয়র। মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্র্ণ হয়ে কিছুদিন আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে তার পরিবারকে মন্ত্রিপাড়ার বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার ৭৯ নম্বর নাজিরা বাজারের বাসায় অবস্থান নেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার পরিবার। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব ¯েœহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনি চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন। মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কোনো দিন কমেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচার্যে থেকে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৫ সালের বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে অত্যন্ত সফলতা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালীন ছয়দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয়দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি রাজপথে প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা ১২ আসন থেকে মোহাম্মদ হানিফ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন।

সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৩০ বছর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দলের প্রতি অনুগত ও প্রিয় নেত্রীর বিশ্বস্ততায় এই মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্বরোচিত হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়া মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালে ৩০ জানুয়ারি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ও বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার আমলে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানম-ি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলী বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্য বর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।
১৯৯৬ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং যার ফলশ্রুতিতে ’৯৬ সালের ১২জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা করেন মোহাম্মদ হানিফ।

একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্পিøন্টার ঢুকে পরে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসায়ও কোনো লাভ হয়নি। স্পিøন্টার মাথার গভীরে বিঁধে থাকায় অস্ত্রোপ্রচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। এই দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ। 
জনগণের কল্যাণই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। রাজনীতির উজ্জ্বল ধ্রুবতারা ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিতে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পূর্বে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্পিøন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।

তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার স্বনামধন্য একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। সফল রাজনৈতিক এবং মানবিক গুণাবলীর অধিকারী মোহাম্মদ হানিফ তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
 
লেখক :  সাংগঠনিক সচিব
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন

×