ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার-২০২৩

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১৮ নভেম্বর ২০২৩

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার-২০২৩

অধ্যাপিক ড. ক্লডিয়া গোলডিন

তিনি বলতে চেয়েছেন যে, পুরুষের তুলনায় কর্মে বা উৎপাদনে নারীর ভূমিকা অসমান বা কিঞ্চিৎকর ছিল। সরবরাহ ও চাহিদার কাঠামোয় তিনি তাঁর প্রায় সব লেখায় শ্রম বাজারে নারীর জন্য বা প্রতিকূলে কি ঘটেছিল, তা ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট ছিলেন। প্রথমত, তিনি দেখিয়েছেন যে সমাজ বিবর্তনে লিঙ্গ ব্যবধান সবসময় সমানভাবে ক্রিয়াশীল ছিল না। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক অর্থব্যবস্থার শিল্পোন্নত ব্যবস্থায় উন্নীত হওয়ার ক্রমে বিবাহিত নারীর শ্রম বাজারে অংশগ্রহণ কমে এসেছিল। বিংশ শতাব্দীতে সেবা ক্ষেত্রের প্রসারের ফলশ্রুতিতে শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

তিনি বলতে চেয়েছেন যে, নারীর শিক্ষার হার ও মান যথা ঈপ্সিত ফল দেয় না, যদি সামাজিক রীতিনীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা প্রাক-বিবর্তন বা উন্নয়নকালে নারীকে কর্মস্থান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে এই প্রেক্ষিতে তাঁর মতে, যথার্থ নীতি প্রণয়ন বা নির্ধারণক্রমে লিঙ্গ ব্যবধানের মূল বা গোড়ার কার্যাদি বা বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণ বিধেয়

২০২৩ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অধ্যাপিক ড. ক্লডিয়া গোলডিন। পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় গত ৯ অক্টোবর। রাজকীয় সুইডিস বিজ্ঞান একাডেমির মহাসচিব অধ্যাপক হানস এলেগরেন ড. ক্লডিয়া গোলডিনকে আলফ্রেড নোবেল স্মরণার্থে সেভরিজ রিংব্যাঙ্ক প্রবর্তিত এই পুরস্কার ঘোষণা করেন। ড. গোলডিন সমকালে বিশ^খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক। ১৯৫৬ সালে নিউইয়র্কে তাঁর জন্ম। শিকাগো বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে তিনি পিইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সুইডিস বিজ্ঞান একাডেমি তাঁকে নারীর শ্রম বাজারের উৎপাদন বিষয়ে আমাদের ধ্যান ধারণা বদলানো এবং উপলব্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে।

তাঁর গবেষণা ও প্রকাশনায় অন্যান্যের মধ্যে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন লরেন্স এফ কাটজ। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘লিঙ্গ ব্যবধান উপলব্ধিকরণ : আমেরিকান নারীর এক অর্থনৈতিক ইতিহাস’ নাম করেছে। তেমনি ২০০৮-এ প্রকাশিত তাঁর ও কাটজের লেখা ‘প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রতিযোগিতা’ বিজ্ঞজনদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০১৩ সালে ক্লডিয়া অলিভেটির সহযোগে তাঁর লেখা ও আমেরিকান ইকনোমিক রিভিওতে প্রকাশিত ‘বিচলিত শ্রম সরবরাহ : নারীর শ্রম সরবরাহে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভূমিকার একটি পুনর্মূল্যায়ন’ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অনেক গবেষকদের নতুন ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত লরেন্স কাটজের সহযোগে নারীর কর্মসংস্থান বিষয়ক তাঁর লেখা ৬টি নিবন্ধ এই ক্ষেত্রে উৎসাহী প্রায় সকল গবেষকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। এর বাইরে একই বিষয়ে তিনি রবার্ট এ মারগো, জসুয়া মিচেল, সিসিলিয়া এ রউজ ও কেলিথ সকোলফের সহযোগে আরও কয়েকটি মূল্যবান নিবন্ধ লিখে অর্থনীতিবিদ ও সমাজপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এসব বিষয়ে গবেষণালব্ধ উপসংহার সমূহকে ‘মুক্তির ইঞ্জিন’ হিসাবে বিশ্লেষণ ও সংজ্ঞায়ন করেছেন জোরমী গ্রীন উড, অনন্ত শেষাদ্রি ও মেহমদ ইরকুত্তগলু (দ্রষ্টব্য: মুক্তির ইঞ্জিন: রিভিউ অব ইকোনোমিক স্টাডিজ,২০০৫)
ড. গোলডিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ বছরের শ্রম বাজারের ইতিহাসে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সেদেশের আর্থ-সামাজিক বিবর্তনে লিঙ্গ ব্যবধান অস্তিত্বমান ছিল। অন্যকথায় তিনি বলতে চেয়েছেন যে, পুরুষের তুলনায় কর্মে বা উৎপাদনে নারীর ভূমিকা অসমান বা কিঞ্চিৎকর ছিল। সরবরাহ ও চাহিদার কাঠামোয় তিনি তাঁর প্রায় সব লেখায় শ্রম বাজারে নারীর জন্য বা প্রতিকূলে কি ঘটেছিল, তা ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট ছিলেন। প্রথমত, তিনি দেখিয়েছেন যে সমাজ বিবর্তনে লিঙ্গ ব্যবধান সবসময় সমানভাবে ক্রিয়াশীল ছিল না। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, ঊনবিংশ শতাব্দির প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক অর্থব্যবস্থার শিল্পোন্নত ব্যবস্থায় উন্নীত হওয়ার ক্রমে বিবাহিত নারীর শ্রম বাজারে অংশগ্রহণ কমে এসেছিল।

বিংশ শতাব্দীতে সেবা ক্ষেত্রের প্রসারের ফলশ্রুতিতে শ্রম বাজারে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, নারীর শিক্ষার হার ও মান যথা ঈপ্সিত ফল দেয় না, যদি সামাজিক রীতিনীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা প্রাক-বিবর্তন বা উন্নয়নকালে নারীকে কর্মস্থান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে এই প্রেক্ষিতে তাঁর মতে, যথার্থ নীতি প্রণয়ন বা নির্ধারণক্রমে লিঙ্গ ব্যবধানের মূল বা গোড়ার কার্যাদি বা বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণ বিধেয়।

সাম্প্রতিক বীক্ষণমূলক রচনায় দেখা গেছে যে, নারী ও পুরুষের আয়ের ব্যবধানের মূল কারণ শিশু জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। শিশুর জন্ম দান মাকে এবং ক্ষেত্র বা সময় বিশেষে বাবাকে প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এই প্রেক্ষিতে  শিশুর পালনকারী পিতা বা মাতার ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি পরিবর্তন বিবেচনার দাবিদার। তৃতীয়ত,  এক্ষেত্রে অনুমোদনীয় নীতি নির্ধারণক্রমে পরিবর্তনের গতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া ও বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্মর্তব্য ও বিবেচনীয় যে, কেবল তরুণ-তরুণীরাই মানব মূলধনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে বা বদলাতে সক্ষম।

সেজন্য তাদের একপাশে রেখে সকলের জন্য কর্মক্ষেত্রের সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন বিষয়ক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ফলপ্রসূ হতে পারে না। সর্বশেষ, গোলডিনের মতে, সময়ান্তরিক শ্রম সরবরাহের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ জীবন বিষয়ে নারীর প্রত্যাশা কিংবা ভাবনাই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের ভাবনা বা প্রত্যাশা কিভাবে রূপ নেয় কিংবা এসব কিভাবে সামাজিক নীতি বা কার্যক্রমের আওতায় প্রভাবিত করা যায়, তা বোঝা প্রয়োজন।

ড. গোলডিনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প বিপ্লবের আগে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীর কর্মের পরিধি বা ব্যাপ্তি উৎপাদন নিপুণতার তারতম্যের কারণে পরবর্তী শিল্প বিপ্লবকালীন সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। নীতি প্রণয়নের প্রেক্ষিত হিসাবে তাঁর মতে, শিল্পায়ন বা উন্নয়ন নারীর কর্মসংস্থানের পরিধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ায় বলা চলে না। শিল্পায়ন উত্তরকালে গর্ভনিরোধক পিলের উদ্ভাবন ও ব্যবহার বাড়ার ফলে নারীর গৃহস্থালীতে সন্তান ধারণ ও পালন কেন্দ্রিক সময়ভার কমে যাওয়ায় তার কর্মকাল বাড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে।

ফলত দেখা যায় যে, নারীর কর্মকাল প্রাকশিল্প বিপ্লবকালে উলম্বিকে আয় ও আনুভৌমিকে সময় সম্পর্কিত রেখাচিত্রে  ইংরেজি ইউ অক্ষরের প্রথমাংশের মতো নিচে নেমে গেলেও সময়ান্তরে ইংরেজি ইউ অক্ষরের শেষ দিকের  মতো ওপরে ওঠার আকারের প্রতিফলক হয়েছে। সমকালে এই ইউ অক্ষরের শেষ দিকের  মতো নারীর কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি সময়ান্তরে বেড়ে চলেছে। পরিবর্তনের এই প্রবণতা সংরক্ষণ করতে হলে তাঁর মতে, পুরুষের সঙ্গে নারীর সমশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুবিধার সঙ্গে সন্তান ধারণ ও পালন এবং শ্রমের সময় নমনীয় ভাবে নির্ধারণ নারী শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও পুরুষের আয়ের সঙ্গে সমতা স্থাপনে প্রয়োজন হিসাবে বিবেচ্য।
ড. গোলডিনের বিশ্লেষণ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকদের চাহিদা ও সরবরাহে পরিবর্তন হেতু কিভাবে কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তার প্রতি সজাগ করেছে। তিনি এই প্রেক্ষিতে ৫টি বিষয়ে অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া কাম্য বলে অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে প্রতিভাত করেছেন। এক, শিল্পায়ন ও মধ্যম আয়ের শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কিভাবে সমাজের রূপান্তর ঘটে, তার দিকে অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া কাম্য বলে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুই, প্রযুক্তির বিবর্তন নারীর শ্রম বাজারে কি ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, সে সম্পর্কে তিনি অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের অধিকতর সচেতন করেছেন।

তিন, তিনি সন্তান ধারণ ও পালন বিষয়ে পারিবারিক ও সামাজিক ধ্যান-ধারণার ব্যবধান ও ভূমিকা তুলে ধরেছেন। চার, তিনি শিক্ষার সুযোগের বিস্তৃতি কিভাবে শ্রম বাজারে নারীদের অবস্থান ও প্রগতি পরিবর্তন করতে পারে, তার ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞান ব্যক্ত করেছেন। পাঁচ, তিনি শিক্ষা ও শ্রম বাজারে নারীর প্রবেশাধিকার এবং অবস্থান বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। এসবের আলোকে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শ্রম বাজারে লিঙ্গ ব্যবধান স্পষ্টতর করে নীতি নির্ধারকদের এরূপ ব্যবধান দূর করার পথ ও প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর গবেষণালব্ধ ফল সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বলা চলে।
সন্দেহাতীতভাবে উপরোক্ত প্রেক্ষিতে ড. গোলডিনের গবেষণালব্ধ ফল কতিপয় ক্ষেত্র ও বিষয়ে গবেষক এবং নীতি নির্ধারকের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক, তিনি ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের গবেষণার ফল দিয়ে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, সমাজের বিবর্তন ক্রমে লিঙ্গ ব্যবধান বা বৈষম্যের মাত্রা একই মাত্রার বা ধরনের হয় না। এক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য কোন্ নিয়ামক কোন্ সময়ে ফলদায়ক হবে, তার প্রকৃতি ও উপাদান শনাক্তকরণ প্রয়োজন।

উদাহরণত, নিম্ন আয়ের অনেক সমাজে বা দেশে কেবলমাত্র নারী শিক্ষা বিস্তারের দিকে মনোযোগ দিলেই শ্রম বাজারে নারীর অংশীদারিত্ব বাড়বে বলা যায় না। এর সঙ্গে জীবনযাত্রার প্রণালীর ইতিবাচক পরিবর্তন না আনলে ঈপ্সিত ফল পাওয়া যাবে না বলা চলে। দুই, লিঙ্গ ব্যবধানের মূল কারণ শনাক্তকরণে সমাজ নেতাদের অধিকতর মনোযোগ কাম্য। সন্তান জন্মানো এবং লালন পালন বিষয়ে বিদ্যমান সামাজিক কর্ম বিভাজন বা প্রথাদি বীক্ষণ করে সন্তান ধারণের সংখ্যা কমানো বা বাড়ানোর জন্য কি ধরনের সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ নেওয়া সংগত, তার সামাজিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। গোলডিনের গবেষণালব্ধ ফল এদিকে আমাদের অধিকতর সচেতন করেছে।

তিন, সামাজিক ও পারিবারিক পরিবর্তনের গতি সম্পর্কে গোলডিন আমাদের চেতনাবোধ বাড়িয়েছেন বলা চলে। তিনি ও তাঁর সহযোগীদের মতে, এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত তরুণ বা কম বয়সী নারী-পুরুষের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে নীতি নির্ধারণকরণ অভিপ্রেত। সর্বশেষ, গোলডিনের গবেষণা সন্দেহাতীতভাবে তুলে ধরেছে যে, সময়ান্তরিক শ্রম সরবরাহের পরিমাণ ও প্রক্রিয়া নির্ধারণে নারীর প্রত্যাশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে চেতনাবোধ এক্ষেত্রে অধিকতর ফলপ্রসূ সামাজিক নীতি শনাক্তকরণ ও প্রণয়নে আমাদেরকে সহায়তা করতে পারে।
এসব সম্ভাবনা, ইতিবাচকতা ও সীমাবদ্ধতার পটে ড. গোলডিনের অভিসন্দর্ভ বিষয়ে কয়েকটি মন্তব্য করা বিধেয়। এক, গোলডিনের বিশ্লেষণ ও অনুসিদ্ধান্ত মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং কিয়দংশে উন্নত ইউরোপে দৃষ্ট ঘটনাবলির ভিত্তিতে রূপ পেয়েছে। জাপান ও রাশিয়ার অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ গোলডিনের অভিসন্দর্ভকে অধিকতর প্রয়োগশীলতা দিতে পারত বলা চলে। তেমনি পৃথিবীর অনুন্নত বা উন্নয়নশীল এশীয় ও আফ্রিকান দেশ এবং সমাজ সমূহের পটভূমিকায় তাঁর অনুসিদ্ধান্ত একইভাবে প্রযোজ্য বলা চলে না।

এই ক্ষেত্রে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশসমূহে জনসংখ্যা বা শ্রমবিষয়ক উন্নয়ন নীতি স্থানীয় পারিপাশির্^কতার আলোকে শাণিত বা পরিশীলিত করা বিধেয় হবে। দুই, সম্পদের আধিক্য সত্ত্বেও দক্ষিণ আমেরিকার সমাজ বিবর্তনে নারী ও পুরুষের ভূমিকা কিভাবে কিসের প্রতিফলক, তা তাঁর গবেষণায় প্রতিভাত হয়নি। দৃশ্যত দক্ষিণ আমেরিকায় কৃষি ও পশু পালনের বিস্তৃতি সম্পদ সৃজনে নারী-পুরুষের ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের তুলনায় ভিন্নতর প্রকৃতি প্রতিভাত করেছে। এই বিবেচনায় বলা প্রয়োজন, সেই মহাদেশে ড. গোলডিন ও তাঁর সহযোগীদের নারী শ্রমের বিবর্তন বিষয়ে করণীয় সংস্কার বা ভিন্নতর রূপ প্রত্যাশী।

এই দুটো দিক বিবেচনায় আনলে এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, গোলডিনের বিশ্লেষিত তত্ত্ব বা তথ্য অর্থনীতিতে সর্বজনীনভাবে বিবেচনার জন্য মৌলিক অবদানের উপকরণ বহন করে না। অর্থনীতিতে দারিদ্র্য ও অসমতা বিমোচনমূলক ও মুক্ত বাণিজ্যের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্কার ও পরিবর্তন বিষয়ক যে দাবি বা প্রয়োজন, বিশে^র বিরাট অংশে সমকালে প্রতিভাত, তার দিকে ড. গোলডিন ও তাঁর সহযোগীরা কোনো দৃষ্টি দেননি। এদিক দিয়ে মূল্যায়িত করলে বলা চলে যে, ২০২৩ সালে প্রদত্ত অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার সর্বক্ষেত্র বা জনের জন্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনীয় কোনো অভিজ্ঞান প্রতিফলিত করেনি।
লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী

×