ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ৩০ অক্টোবর ২০২৩

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর

আসাদুজ্জামান নূর

নদ-নদী, বৃক্ষরাজি, ফুল-ফসল ও চিরসবুজের দেশ বাংলাদেশ। দেশটির সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত জেলা নীলফামারী। নীলফামারীর নাম শুনতেই মানসপটে ভেসে ওঠে দিগন্তবিস্তৃত সমভূমি। কোনো কোনো সময় যখন একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, মানুষকে ভালোবাসার আকুতি, অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার যে অন্তর্নিহিত শক্তি নিরন্তর কাজ করে, সচরাচর সবার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। উত্তরের কৃতীসন্তান দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জননেতা আসাদুজ্জামান নূর সেই বিরল ব্যক্তিত্বের অন্যতম। যিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে নিজেকে বার বার ছাড়িয়ে গেছেন। 
১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর জন্ম নেওয়া আসাদুজ্জামান নূরের জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। কলেজ জীবনেই তিনি রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করে জীবনের আদর্শ স্থির করেছেন এক অবিচল কেন্দ্রবিন্দুতে, যেখানে জনগণের কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি মনোযোগী ছিলেন সাংগঠনিক কাজকর্র্ম নিয়ে। ছাত্রজীবনেই অনুধাবন করেছেনÑ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে রাজনীতির হাজারো কূট-কৌশলের মাধ্যমেই এগোতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের মন্ত্রে  উজ্জীবিত হয়ে জীবন বাজি রাখতে হবে।

সে কারণেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। স্বার্থ, দ্বন্দ্ব, আর্থিক লোভ- এসব কখনো ঘেঁষতে পারেনি তার রাজনীতিতে। এ রাজনীতি তাকে শিখিয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে থাকতে, মানুষকে ভালোবাসতে, আবার প্রয়োজনে মানুষের দাবি আদায়ে সোচ্চার হতে। ছাত্রজীবনেই তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর- দেশের সকল ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, রাজনৈতিক গতিধারায় তিনি অসীম প্রজ্ঞা আর সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।  
১৯৭২ সালে বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক চিত্রালীতে কাজ করার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার অধীনে ছাপাখানার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত দূতাবাসের (বর্তমানে রাশিয়া) প্রেস রিলেশন অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডে (বর্তমানে এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি) সাধারণ ব্যবস্থাপক পদে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সদস্য, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদস্য ও বাংলাদেশ রাশিয়া মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নব্বইয়ের দশকে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে দেশব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। দেশ টিভিতে প্রচারিত ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। 
নূরের অভিনয় জীবনের শুরু থিয়েটার থেকে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত হন। সে সময়ে তিনি ‘চিত্রালী’র অভ্যর্থনাকারী ছিলেন এবং বিখ্যাত অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার নিতে যেতেন। এভাবেই তিনি আলী জাকেরের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি ছিলেন নাগরিক সম্প্রদায়ের। প্রথমে দলটির একটি নাটকের মহড়ায় গিয়ে দলটির অংশ হয়ে যান তিনি। প্রথমে নেপথ্যে কণ্ঠদান দিয়ে শুরু করেন। ‘তৈল সংকট’ নামক একটি নাটকের আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনীর মাত্র দুদিন বাকি থাকা অবস্থায় এর প্রধান অভিনেতা আবুল হায়াত হঠাৎ আহত হয়ে পড়েছিলেন। নেপথ্যের কণ্ঠদানের কারণে নূর নাটকের প্রতিটি লাইনই জানতেন।

আলী জাকের নূরকে আবুল হায়াতের চরিত্রটি করতে বলেন। এভাবেই তার অভিনয়ের শুরু। তিনি এই দলের ১৫টি নাটকে ৬০০ বারেরও বেশি অভিনয় করেছেন। দুটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, যার মধ্যে দেওয়ান গাজীর কিসসা প্রায় তিন শতাধিকবার মঞ্চায়িত হয়ে সর্বোচ্চ প্রদর্শিত মঞ্চ নাটকের রেকর্ড গড়েছে। নূরের প্রথম টেলিভিশনে অভিনীত নাটক ১৯৭৪ সালে ছিল রং এর ফানুস, যার পরিচালক ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি মঞ্চের জন্য ব্রেখটের নাটকের বাংলা অনুবাদ, রবীন্দ্রনাথের তিনটি উপন্যাসের টিভি নাট্যরূপ এবং টিভির জন্য একটি মৌলিক নাটক রচনা করেছেন। এ মোর অহংকার ও দেওয়ান গাজীর কিসসা তার পুস্তিকাকারে প্রকাশিত নাটক।

নিজস্ব পরিচালনায় তিনি ৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপনচিত্র ও ভিডিও ছবি নির্মাণ করেন। টেলিভিশনে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে এইসব দিনরাত্রি (১৯৮৫), অয়োময় (১৯৮৮), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), আজ রবিবার (১৯৯৯) ও সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৯৯)। রেডিওতে প্রচারিত নাটকের সংখ্যা ৫০ এরও বেশি। টেলিভিশনের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো শঙ্খনীল কারাগার (১৯৯২) ও আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)। সংস্কৃতিতে অবদান রাখার জন্য ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। 
আসাদুজ্জামান নূর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি নীলফামারী কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে বিরত রেখে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি পর্যায়ে তিনি আবারও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন।

আসাদুজ্জামান নূর নীলফামারী-২ আসন থেকে ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ৯ম জাতীয় সংসদের বিভিন্ন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সদস্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ১২ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে তিনি একই আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 
নীলফামারীর এক সাধারণ শিক্ষক দম্পতির সন্তান আসাদুজ্জামান নূর। সাধারণ হয়েও অসাধারণ আমাদের এই মাটিও মানুষের নেতা। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে সময়কে অতিক্রম করে দেশের মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন তাকে টেনে নিয়ে গেছে খ্যাতির চূড়ায়। সম্মানের উচ্চ শিখরে। তাই সাধারণ হয়েও অসাধারণ উত্তরের প্রাণপুরুষ আসাদুজ্জামান নূর।
 
লেখক : আইনজীবী, পিএইচ.ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়

[email protected]

×