
ছবি: প্রতীকী
বর্তমানে অফিস, ফ্রিল্যান্সিং কিংবা অনলাইনে ক্লাসের কারণে অনেক মানুষকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডেস্কে বসে কাজ করতে হয়। এই দীর্ঘসময় বসে থাকার অভ্যাস ধীরে ধীরে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। প্রথমদিকে বিষয়টি তেমন চোখে না পড়লেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
দীর্ঘ সময় একটানা বসে থাকার ফলে শরীরের রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঠিকমতো রক্ত পৌঁছাতে না পারলে নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে পায়ের দিকটায় রক্ত জমে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, যা পরবর্তীতে ভেরিকোস ভেইনের মতো সমস্যায় রূপ নিতে পারে।
এর পাশাপাশি দীর্ঘ সময় বসে থাকার ফলে পিঠ ও ঘাড়ের ব্যথা খুব সাধারণ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ডেস্কে কাজ করার সময় আমরা অনেক সময় সঠিক ভঙ্গিতে বসি না, অনেক সময় সামনে ঝুঁকে কাজ করি বা কাঁধ বাঁকা করে রাখি। এসব কারণেই ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে এবং পিঠব্যথা শুরু হয়। দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যা সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস বা ডিস্ক স্লিপের মতো জটিল রোগে পরিণত হতে পারে।
চোখের সমস্যাও দেখা দেয় নিয়মিত ডেস্কে বসে কম্পিউটারে কাজ করলে। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখে চাপ পড়ে এবং দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। একে বলে 'ডিজিটাল আই স্ট্রেইন' বা 'কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম'। চোখে শুষ্কতা, জ্বালা, বা কখনও কখনও মাথাব্যথাও হতে পারে।
এছাড়া যেসব মানুষ একটানা ডেস্কে বসে থাকেন, তাদের ওজন বাড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বসে থাকার সময় শরীরের ক্যালোরি পোড়ানোর হার কমে যায়, ফলে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমে। এতে করে ধীরে ধীরে স্থূলতা তৈরি হয়। অতিরিক্ত ওজন আবার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
দীর্ঘসময় বসে থাকার আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব হলো মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা। শরীর যখন সক্রিয় থাকে না, তখন মস্তিষ্কেও তার প্রভাব পড়ে। সক্রিয়তা আমাদের মস্তিষ্কে ভালো হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু সারাদিন এক জায়গায় বসে কাজ করলে সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে মানসিক ক্লান্তি বাড়তে থাকে।
অনেক সময় দেখা যায়, যারা দীর্ঘ সময় ডেস্কে বসে কাজ করেন, তারা যথেষ্ট পানি পান করেন না। আবার অনেকেই সময়মতো খাবার খান না বা হালকা খাবার খেয়ে কাজ চালিয়ে যান। এতে করে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয় এবং পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। এসব কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় একটানা বসে কাজ করেন, তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি যেসব মানুষ নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তারাও যদি দিনের বড় অংশ বসে বসে কাটান, তাহলেও সেই ব্যায়ামের উপকার অনেকাংশেই হ্রাস পায়।
এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। প্রতি ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পরপর উঠে হেঁটে আসা, হালকা স্ট্রেচিং করা, সঠিক ভঙ্গিতে বসা, পর্যাপ্ত পানি পান ও চোখের বিশ্রাম নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং ডেস্কের উচ্চতা ও চেয়ারের ভঙ্গিমা এমনভাবে ঠিক করতে হবে যেন তা শরীরের ক্ষতি না করে বরং আরামদায়ক হয়।
অতএব, দীর্ঘ সময় ডেস্কে বসে কাজ করা আজকের কর্মব্যস্ত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আমাদের উচিত এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলে নিজের শরীরকে সুস্থ রাখা। শরীর সুস্থ থাকলেই মন ভালো থাকবে, আর মন ভালো থাকলেই কাজেও সফলতা আসবে।
এম.কে.