ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

অতিমাত্রায় বিদেশপ্রীতি হতে পারে বুমেরাং

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৩ অক্টোবর ২০২৩

অতিমাত্রায় বিদেশপ্রীতি হতে পারে বুমেরাং

মো. সাখাওয়াত হোসেন

সম্প্রতি বিএনপির কয়েকজন  সিনিয়র নেতার সিঙ্গাপুর সফরকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে ব্যাপক সোরগোলের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করার পাঁয়তারা থেকেই বিএনপির নেতৃবৃন্দ বিদেশনির্ভর পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। সে বিবেচনাতেই বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা একযোগে সিঙ্গাপুর যান। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির বিষয় উঠে আসে প্রাসঙ্গিকভাবেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, অতিমাত্রায় বিদেশপ্রীতি মূলত দলটির জন্যই বুমেরাং হিসেবে দেখা দিয়েছে। আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের মাঝপথে বিএনপি নেতাদের বিদেশ সফর দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তথা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিষয়টি বোঝা উচিত।

বাংলাদেশের অবস্থা এখন আর এমন পর্যায়ে নেই যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস দেখাবে। ব্যাপারটি কিন্তু তেমনই হচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে। বিএনপির এক দফা দাবি হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এ দাবি নিয়ে বিএনপি নেতৃবৃন্দ বিদেশী দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করে দাবির বিষয়ে অবগত করেছেন। কিন্তু বিএনপির এ দাবির সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের তেমন যোগসাজশ কিংবা সামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে না। তবু বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিদেশপ্রীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রবলভাবে। 
বিদেশীদের অভিমত হচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বিদেশীদের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতার অংশ হিসেবে বিদেশীরা সরকারকে এ বিষয়ে অবগত করেছেন। সরকারও বিদেশীদের আশ্বস্ত করেছে সুষ্ঠূ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের নিমিত্তে বদ্ধপরিকর সরকার। তাহলে বিদেশীদের প্রত্যাশার সঙ্গে সরকারের চাওয়া-পাওয়ার মিল থাকায় নির্বাচন বিষয়ে বিদেশীদের আর কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিদেশীরা সন্তুষ্টি জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও বলেছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবে।

বিএনপির অতিমাত্রায় বিদেশপ্রীতি বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে এক দফা দাবি তুলে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে তাগাদা প্রদান দলটিকে প্রকৃত অর্থে দুর্বল করে দিচ্ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে এই অর্থে যে, বিদেশীদের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজস্ব দলের প্রতি, দলের কর্মী-সমর্থকের প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের মধ্যে একটি বিভাজন রয়েছে। বর্তমানে অনেক জায়গায় বিভাজন প্রকাশ্যে চলে আসছে।

কিছুদিন আগে দেখা গেল বিএনপিতে জেলার এক নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করছে সংশ্লিষ্ট জেলার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিরোধে। এ ধরনের অনুষঙ্গ দলটিকে কার্যকরভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসছে। ফলশ্রুতিতে আহূত আন্দোলন-সংগ্রাম তেমন সাড়া ফেলতে পারছে না। 
অন্যদিকে বিএনপি যে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়, সেই বিদেশীরা কিন্তু সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে সরকারপ্রধানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানগণ দ্বি-পক্ষীয় ইস্যুতে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিয়মিত কাজ করার সদিচ্ছা ব্যক্ত করছেন। মূলত বিদেশীদের দরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিদেশীরা অন্য দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন প্রতিনিয়ত। বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বিদেশীদের বিনিয়োগে এখন এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিদেশীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে এবং বিনিয়োগ করে দ্রুত রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। বিদেশীরা সব সময়ই চান বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। সে লক্ষ্যে বিদেশী বন্ধুরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সংবিধানের বাইরে সরকারকে কিছু করার অনুরোধ জানাবেন, এমন ভাবার অবকাশ নেই। ইত্যবসরে বিদেশীদের বক্তব্যে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। কিন্তু নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে সে ব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করেননি। উল্টো বলেছেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মানে হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচন কিভাবে হবে সে বিষয়ে কথা বলার একমাত্র অধিকার বাংলাদেশের জনগণের। বিদেশীরা এ জায়গায় বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে সম্মান জানাবেন, এটিই কাম্য। 
বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যত কোনোরূপ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপির সঙ্গে জনগণের একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। তাছাড়াও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে নানাবিধ কারণে। বিএনপির শীর্ষনেতাদের একযোগে সিঙ্গাপুর সফরকে কেন্দ্র করে বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব নিজেরা বিদেশ গিয়ে বিপদে ফেলেছে কর্মীদের। অবশ্য বিএনপিতে এমন ঘটনা আগেও দেখা গেছে। বিশেষ করে বিএনপির নেতারা হরতাল-অবরোধ ডেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঠিকই চালু রেখে দলের তৃণমূলকে নামিয়েছে রাস্তায়। এ ধরনের ঘটনা থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের তথা জেলার নেতাদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জেলায় মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি থাকায় কর্মী-সমর্থকরা ঝিমিয়ে পড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির কর্মীরা রাজনৈতিকভাবে তথা সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় রাজনীতি করছে না। 
সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে বিএনপির শীর্ষনেতা দ-প্রাপ্ত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছে। অনলাইনে ভাষণ দিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এ বিষয়টিও বিএনপির অনেকেই মেনে নিতে পারছে না। রাজনীতিতে আসলে ত্যাগ থাকতে হয়। কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হয়। কর্মীদের আন্দোলনের ডাক দিয়ে নিজে আন্দোলন থেকে দূরে থাকলে কর্মীরা সেটা সহজভাবে গ্রহণ করে না। এর প্রমাণ কিন্তু বর্তমান বিএনপি। বলতে গেলে এক ধরনের নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় দলটি টিকে আছে রাজনীতিতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির দলীয় প্রধানকে মুক্তির আন্দোলনে দলের সিনিয়র নেতারা তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি দেখে দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সিনিয়র নেতাদের প্রতি বিক্ষুব্ধ। সব মিলিয়ে দলটি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দলের মধ্যে শৃঙ্খলার ঘাটতি থাকায় তাদের ঘোষিত আন্দোলনও তেমনভাবে সাধারণ জনতার মধ্যে সাড়া ফেলছে না। 
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির উচিত হবে দলটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা। আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিমিত্তে সারাদেশে কর্মী ও নেতাদের উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা। বিদেশপ্রীতি ও বিদেশনির্ভরতা পরিহার করে দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করা বিএনপির অবশ্য কর্তব্য। জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিলে রাজনীতিতে কেবলমাত্র বিদেশীদের ওপর ভরসা করে টিকে থাকা অত্যন্ত দুরূহ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনোরূপ আশঙ্কা নেই। সে কারণেই রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত দলটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী এবং আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করা। 
লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়