ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিচার বিভাগ কেন রাজনৈতিক রোষের শিকার

মো. জাকির হোসেন

প্রকাশিত: ০১:০৯, ২ অক্টোবর ২০২৩

বিচার বিভাগ কেন রাজনৈতিক রোষের শিকার

.

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ নাগরিক নীরদ সি. চৌধুরী লিখেছিলেনআত্মঘাতী বাঙালি বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড দেখলে মনে হয় সমালোচক নীরদ বাবু ঠিকই বলেছেন। বাঙালিরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করছে। মর্যাদাকে করছে ভূলুণ্ঠিত। ৩০ লাখ শহীদ আর অসংখ্য কন্যা-জায়া-জননীর চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া রাষ্ট্রটিকে বিদেশীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়ে প্রতিনিয়ত অপমান করছি। কত সহজেই ধ্বংস করতে জানি আমরা, কিন্তু গড়তে জানি না। এমনি একটি ধ্বংসাত্মক আত্মঘাতী কাজ হলো বিচার বিভাগের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ। রাজনৈতিক আন্দোলনের অপকৌশল হিসেবে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। বিএনপির কোনো রাজনৈতিক নেতার অপরাধের বিরুদ্ধে রায় হলে তাকে ফরমায়েশি রায় বলা হচ্ছে। ক্ষমতা পরিবর্তন হলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচার করা হবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আদালতে হচ্ছে জুতা মিছিল।

রায়ের বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আক্রমণে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে পোস্টারিং। সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে ৬৪টি জেলা আইনজীবী সমিতিতেউই ডোন্ট ওয়ান্ট বায়াস অ্যান্ড আনফেয়ার জুডিশিয়ারি’– লেখা সংবলিত পোস্টার লাগিয়েছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তারেক রহমানের ছবি সংবলিত সেই পোস্টার। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল পোস্টারের বিষয়ে বলেছেন, আমাদের কথাই ওই পোস্টারে লেখা আছে। সারাদেশে বিচারের নামে প্রহসন চলছে। আদালতের পরিবেশ আজ দ্বিধাবিভক্ত। আজ বিএনপির জন্য এক আইন প্রচলিত, অন্যদের জন্য আরেক আইন। কারণে আমরা বলছিউই ডিমান্ড ইমপারসিয়াল অ্যান্ড ফেয়ার জুডিশিয়ারি’ (আমরা নিরপেক্ষ স্বচ্ছ বিচার বিভাগ চাই) বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, দেশে ১৮ কোটি মানুষ আছে, তাদের কথার প্রতিধ্বনি, তাদের যে আকুতি, কথা বলার বহির্প্রকাশ সেটি হলো এই পোস্টার। বাংলাদেশের মুক্তিকামী গণতন্ত্রপন্থি যারা আছে তাদের অ্যাডভোকেসি করছে এই পোস্টার।

প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি বিএনপির জন্য এক আইন প্রচলিত, অন্যদের জন্য আরেক আইন? কথাটি আদৌ সত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ,’ আর প্রস্তাবনার শেষে বলা হয়েছে, ‘এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তেরোশত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠারো তারিখ, মোতাবেক উনিশশত বাহাত্তর খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।আমরা বলতে নিশ্চয়ই বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদেরও বোঝায়। বাংলাদেশে একাধিক সংবিধান চালু রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ১৮৬০ সালের ন্ডবিধি আইনের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘WHEREAS it is expedient to provide a general Penal Code for Bangladesh; অর্থাৎ, আইনটি বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং সবার জন্য প্রযোজ্য। নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘This Act„„„shall take effect throughout Bangladesh আর নং ধারায় বলা হয়েছে, Every person shall be liable to punishment under this Code  আইনটি স্পষ্টতই বলছে, এটি সমগ্র বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি এই আইনের বিধানাবলী লঙ্ঘনের জন্য দায়ী হবে। আইনের কোথাও বলা হয়নি যে, এটি কেবল বিএনপির জন্য কিংবা বিএনপি বাদে অন্যদের জন্য প্রযোজ্য। অন্যান্য আইনের মুখবন্ধেও সাধারণভাবে এই কাঠামোটিই ব্যবহার করা হয়।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেছেন, দেশে ১৮ কোটি মানুষ আছে, তাদের কথার প্রতিধ্বনি, তাদের যে আকুতি, কথা বলার বহির্প্রকাশ সেটি হলো এই পোস্টার। বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামালের বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে বিএনপি ব্যতীত আর কেউ পোস্টার লাগায়নি কেন? কারণ, দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দ জানেন, বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে আক্রমণ নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। বিচার বিভাগের ওপর অনাস্থা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। বিচারে বিলম্ব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে এটি সত্য। কিন্তু বিলম্বের জন্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই দায়ী। তাই বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ক্ষোভে রূপ নেয়নি। বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ পোস্টার লাগানোর মতো ধ্বংসাত্মক কাজে জড়ায়নি। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।বিএনপি বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণাকে উসকে দিচ্ছে তার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশী শক্তি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান পরিচালক এস এম নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ডে রায় ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে রায়ের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা ঘটনা, বিচারের নথিপত্র, উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক, ন্ডদানের পক্ষে বিচারকের যুক্তি কিছুই না দেখে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্টের বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল বিবৃতি দিয়ে দিলেন! তদুপরি এটি চূড়ান্ত রায় নয়।

এর বিরুদ্ধে একাধিক আপিলের সুযোগ রয়েছে। ইইউ পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এবং কয়েকটি এনজিও একইরূপে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে সিরিজ বিবৃতি দিতে শুরু করল। এমন পরিস্থিতি কিভাবে সৃষ্টি হলো? বিএনপি তাদের মিত্ররা ক্রমাগতভাবে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার যে অপকৌশল গ্রহণ করেছে তারই সূত্র ধরে বৈদেশিক শক্তির এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। বিএনপির একটি অভিযোগতাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা হয়েছে। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে দিন-মাস-বছরব্যাপী। প্রশ্ন হলো, এর কোনো একটি মামলাও কি বিচারক কিংবা বিচার বিভাগ করেছেন? কোনো মামলা আদালতে রুজু হলে তা কি বিচারক শুনানি না করে নিজের খেয়াল-খুশি মতো ফিরিয়ে দিতে পারেন? রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রবণতা এই সরকারের সময়েই কি শুরু?

স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে জেলে কাটাতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিচার বিভাগকে আক্রমণ করেননি। বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাননি। বিক্ষুব্ধ জনতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারক পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি  এস, , রহমান সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদেরের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে বিচারপতি  এস, , রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন। যে বিচারকরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে লটকানোর আয়োজন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দেখাও করেছেন। বিএনপি গায়েবি মামলার অভিযোগ করছে। বিএনপি কি তাদের প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেয়নি? বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান জামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে ঘড়ি চুরির মামলা দেওয়া হয়েছিল। আর শত শত কোটি টাকার ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল চামচ চুরির মামলা।

বিএনপি জামাতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জঙ্গিরা মিলে আওয়ামী লীগের জনসভায় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্রেনেড হামলা করে একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন, শত শত নেতাকর্মী আহত হয়েছিলেন। থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতেই চায়নি। তর্ক-বিতর্কের পর মামলা হিসেবে না নিয়ে কেবল জিডি হিসেবে গ্রহণ করেছিল থানা। মামলা ভিন্নখাতে পরিচিালিত করতে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়ার শাসন আমলে যেমন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা হয়েছিল, তেমনি খালেদা জিয়ার শাসন আমলেও তা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সেজন্য বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে পোস্টারিং করা হয়েছিল কি? হয়নি। কারণ, কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হয় এমন কাজ করতে পারে না। বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অনাস্থা সৃষ্টি হলে তো রাষ্ট্র ধ্বংসের মুখোমুখি হতে পারে।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বিচার বিভাগের পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ টেনে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা ছিল বছরের, উচ্চ আদালতে এসে তা বেড়ে হলো ১০ বছর। আর তারেক রহমানের মামলায় নিম্ন আদালতে কোনো সাজাই ছিল না, তাকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। অথচ মানুষ উচ্চ আদালতে আসেন দন্ড থেকে মুক্তি পেতে। প্রকৃত সত্য হলো, বেগম জিয়ার মামলায় অপরাধের সহায়তাকারীদের ১০ বছর সাজা হয়েছিল, অথচ মূল অপরাধী বেগম জিয়ার বছর কারাদ- হয়েছিল। উচ্চ আদালতে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তথা নোটিস প্রদান করে মূল অপরাধীর সাজা সহায়তাকারীদের সাজার সমান করা হয়েছে। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

উচ্চ আদালতে সাজা বৃদ্ধির ঘটনা স্বাভাবিক বিষয়। উদাহরণস্বরূপ জেলহত্যা মামলা পিলখানা ট্র্যাজেডির মামলায় নি¤œ আদালতের দেওয়া সাজা বৃদ্ধি করা হয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডির মামলায় ১০ বছরের কারাদন্ডকে যাবজ্জীবন এবং যাবজ্জীবনের সাজাকে বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডও দেওয়া হয়েছে। আর তারেক জিয়ার মামলায় সাক্ষ্য মূল্যায়নে নিম্ন আদালতের ভুলের সংশোধন করা হয়েছে। নিম্ন আদালত কর্তৃক ঘোষিত খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে সাজা দেওয়ার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। বিএনপির বিচার বিভাগ দলীয়করণের অভিযোগ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। নিম্ন আদালতের বিচারকগণ তীব্র প্রতিযোগিতামূলক কয়েক ধাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিচারক হন। শুরুতে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ১০০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রতিটি উত্তরপত্র কোডিং করে দুইজন পরীক্ষকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। দুইজন পরীক্ষকের নম্বরের গড় করে নম্বর চূড়ান্ত করা হয়। দুইজন পরীক্ষকের নম্বরের ব্যবধান ২০-এর বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে তৃতীয় পরীক্ষকের নম্বরের সঙ্গে প্রথম দ্বিতীয় পরীক্ষকের নম্বর যোগ করে গড় করে নম্বর চূড়ান্ত করা হয়। এরপর ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ - জনের বোর্ডের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রদান করা হয় বোর্ডের সামনে প্রার্থীর পারফরমেন্সের ভিত্তিতে। বোর্ডের সদস্যদের আলোচনার ভিত্তিতে। নি¤œ আদালতের বিচারকগণ নিয়োগপ্রাপ্ত হন সম্পূর্ণভাবে মেধাভিত্তিক ফলের দ্বারা। ফলে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই।

নিম্ন আদালতে যারা বিচারক তাদের অনেককে জানি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যারা ছাত্রদল কিংবা ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতাদর্শের ছিলেন। কাজেই বিচার বিভাগ দলীয়করণের প্রশ্নটি একেবারেই অবান্তর। উচ্চ আদালতের বিচারকদের একটি অংশ আসেন নিম্ন আদালতের সর্বোচ্চ পদ জেলা দায়রা জজ থেকে। আরেকটি অংশ নিয়োগপ্রাপ্ত  হন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্য থেকে। এই নিয়মটি চালু করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। বিশ্বের বহু দেশে আইনজীবীদের মধ্য থেকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের বিধান রয়েছে এবং রাষ্ট্রপ্রধান এই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যে পদ্ধতিতেই নিয়োগ হোক, প্রকাশ্য আদালতে অনুষ্ঠিত হয় বিচার। ইনকুইজেটোরিয়াল বিচার ব্যবস্থার বিপরীতে আমাদের এ্যাডভারসারিয়াল বিচার ব্যবস্থায় বিচারক কেবল আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করেন। মূল আইনি লড়াই হয় দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। একপক্ষের যুক্তি-তর্ক-সাক্ষ্য - করে অপরপক্ষ যুক্তি-তর্ক-সাক্ষ্য উপস্থাপন না করতে পারলে তার দায় ওই আইনজীবীর। কোনো পক্ষ মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপন করলে প্রতিপক্ষ - করতে না পারলে বিচারকের কি করার আছে? বিচারক যখন রায় লেখেন উভয়পক্ষের উপস্থাপিত ঘটনার সারসংক্ষেপ, তাদের উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক সাক্ষ্য-প্রমাণের কথাই রায়ে উল্লেখ করেন। কোনোকিছুই গোপনে করা হয় না। এখানে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কোথায়? হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও যদি বিএনপি মনে করে নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট আপিল বিভাগ সবই দলীয়করণ হয়ে গেছে, সবাই আওয়ামী লীগ, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সরকার চালাবে কিভাবে? এই বিচারকদের তো আর বিএনপি নিজেদের ইচ্ছেমতো অপসারণ করতে পারবে না।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘তুমি যত মূল্যবান হবে, তত বেশি তুমি সমালোচনার পাত্র হবে কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ অতি মূল্যবান। বিচার বিভাগের সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করা, অনাস্থা সৃষ্টি করা আত্মঘাতী। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্রতি বিনীত আবেদন, দায়িত্বশীল আচরণ করুন। বিচার বিভাগ জাগতিক ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। সবকিছুকে রাজনীতিতে টেনে আনা যায় না। টেনে আনা উচিতও নয়। বিচার বিভাগকে তো নয়ই।

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

×