.
বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিকাশমান ও শক্তিশালী হচ্ছে। সৌদির জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশী জনগণের আন্তরিক, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতি বছর ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রী হজ করেন। প্রায় ৪ লাখ ওমরাহ পালন করেন। ২৮ লাখের বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, যাদের বাংলাদেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে সম্পর্ক শুধু হজ ও ওমরা এবং সৌদিতে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সৌদি এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরব মুসলিম ও আরব বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের ভিত আরও মজবুত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ বার রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরব গমন করেছেন। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ফলপ্রসূ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। ফলশ্রুতিতে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতার দিকে ধাবিত। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে সৌদি আরবের ৪ জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের গতিপ্রাপ্ত হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত সৌদি বিনিয়োগের ফলে বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সৌদি আরব তেলসমৃদ্ধ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সৌদি ধনকুবেরদের যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বহু বিনিয়োগ আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের দিকে সৌদি বিনিয়োগকারীরা ধাবিত হওয়ায় বিনিয়োগকারী দেশের তালিকায় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ সৌদি আরব যুক্ত হলো। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সৌদি ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিক সার্ভিস মন্ত্রী ইঞ্জি. সালেহ আল জাশের বাংলাদেশ সফর করেন এবং সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone), ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৩০০ একর জমি বরাদ্দ করা হয় চট্টগ্রামে। এই বিশেষ শিল্পাঞ্চল চালু হলে বাংলাদেশের বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সৌদি আরবের বিপুল সংখ্যক বড় বিনিয়োগকারী বিশ্বের অনেক দেশে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। সৌদি আরবের জন্য বাংলাদেশে নির্ধারিত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্বচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করতে শুরু করবে। যেহেতু কম পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাওয়া যায়, তাই সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
সৌদি মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল আল ফাহাদ। ২০২২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
বাংলাদেশের মতো ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের উন্নয়নে সৌদি আরবের সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করেন তিনি। মাজেদ বিন আবদুল্লাহ আল কাশাব– সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তার সফরের সময় তিনি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এছাডাও সৌদি আরবের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. নাসের আদ দাউদ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। ২০২৩ সালের আগস্টে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. তৌফিক বিন ফাওজান আল-রাবিয়াহ্, অন্য একজন মন্ত্রী, ৩ জন উপমন্ত্রীসহ ১৬১ জন সফরসঙ্গীসহ বাংলাদেশ সফর করেন। সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে সৌদি পরিবহন ও লজিস্টিক সার্ভিস মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ও সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রীর সফর থেকে বোঝা যায় , দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার পারদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের প্রায় ২৮ লাখ প্রবাসী সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স সৌদি আরব থেকেই আসে সর্বোচ্চ পরিমাণে।
হজযাত্রীদের সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন ঢাকায় সম্পন্ন হচ্ছে। এতে লাখ লাখ হজযাত্রীর সৌদি আরবের জেদ্দা বা মদিনা এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনা থেকে নিষ্কৃৃতি পাচ্ছেন। তাদের ব্যাগেজও ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে সৌদি আরবের মক্কা/মদিনার হোটেলে পৌঁছে দেয়। এতে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বহু বিড়ম্বনা লাঘব হয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক হজযাত্রীদের বিমানবন্দরে ব্যাগ হ্যান্ডলিং ও হোটেলে যেতে কষ্ট করে ব্যাগ বহন করতে হয় না।
বাংলাদেশী মুসলমানদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন হজ ও ওমরাহ পালন। ২৮ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসীর কর্মস্থলের গন্তব্য হওয়া ছাড়াও, সৌদি আরব এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। এদিকে সৌদি আরবের বিখ্যাত পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ‘অ্যাকোয়া পাওয়ার’ বিদ্যুৎ খাতে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সৌদি অ্যাকোয়া পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৭৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্লান্টের নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। এছাড়াও এক হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ। এই সম্পর্ক ক্রমশ সুদৃঢ় হতে থাকায় পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ সীমাহীন হয়ে পড়েছে। সৌদি আরবের অনেক বিখ্যাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে। ভবিষ্যতে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্ক আর্থিক সহযোগিতায় আরও দৃঢ় এবং বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবে। উভয় ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ একে অপরকে যথাযথ সম্মান, গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে।
বাংলাদেশে সৌদি আরবের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আল দুহাইলানের রাষ্ট্রদূত হয়ে বাংলাদেশে আগমনের পর থেকেই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর এবং বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সৌদি আরব একটি আধুনিক আরবী ভাষা ও সংস্কৃত ইনিস্টিটিউট স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। সৌদি অর্থায়নেই এই ইনস্টিটিউট ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যার মাধ্যমে আমাদের সৌদিগামী চাকরি প্রার্থীগণ আরবী ভাষা এবং সৌদি সাংস্কৃতিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ পাবেন। বর্তমানে আমাদের বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক কাজের কোনোরূপ পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ এবং ভাষা জ্ঞান ছাড়া সৌদি আরব গমন করেন এবং কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। সৌদি আরবের অর্থায়নে স্পেশালাইজড আরবী ভাষা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সৌদি আরব গমন করে আমাদের প্রবাসীরা আরও বেশি অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবেন এবং দেশ উপকৃত হবে।
তাছাড়াও সৌদি আরব বড় বড় নতুন অর্থনৈতিক জোন ও বিশেষ সিটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে ভবিষ্যতে আরও বহু বাংলাদেশীর কর্মসংস্থানের সুযোগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌদি আরবের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের সকল জনগণের পক্ষ থেকে ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের সরকারও জনগণের পক্ষ থেকে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আশা করি, ভবিষ্যতে দুদেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ করে তারা লাভবান হবেন এবং এতে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। দুদেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক পারস্পরিক উন্নয়ন ও অংশীদারিত্বের সম্পর্কের ব্যাপক বিস্তৃৃতি লাভ করছে ক্রমশ।
লেখক : সভাপতি, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ