.
তেইশ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলো। সারা বিশ্ব এই দিনটি অন্তরের গভীর আবেগ দিয়ে পালন করে থাকে। এবার তার আরও বিস্তৃতি ঘটেছে। দিনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫২ সালে আমাদের ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া শহীদদের স্মৃতিকে নির্ভর করে। ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলের সেই ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি এখন এমনকি খোদ পাকিস্তানেও পালিত হয়।
বিশ্বের বহু দেশে আমাদের শহীদ মিনারও আছে। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই এই দিনটিও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। বিশ্বজুড়ে বাঙালির এক অসাধারণ অর্জন এটি। তবে মাতৃভাষা বাংলার জন্য রক্ত কেবল আমরাই দিইনি, ভারতের অসমে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাতৃভাষাপ্রেমীরা রক্ত দিয়েছে। এছাড়াও বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চলছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’২৩ উপলক্ষে আমরা একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা ভাষার লড়াইতে তাঁর নেতৃত্ব¡দান ও বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছি। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে অতিক্রম করে এটি ছিল আমাদের ক্ষুদ্র নিবেদন। অন্যদিকে সারা বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য যে লড়াই তারও ছোট একটি বিবরণ তুলে ধরব।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভাষা আন্দোলন হয়েছে বেলজিয়াম, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান অঞ্চল, স্পেন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, আমেরিকা এবং কানাডাসহ অনেক দেশে। মাতৃভাষা রক্ষায় ছাত্র থেকে শুরু করে আপামর জনতা সব সময় সোচ্চার। ভাষার জন্য আন্দোলন কোথাও অহিংস আবার কোথাও সহিংস। আবার স্বাধীন দেশে বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার লড়াই হয়েছে, এখনো চলছে।
বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ ছাড়া ইউরোপের বলকান অঞ্চল, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে আন্দোলন হয়েছে স্প্যানিশ-ইংরেজি নিয়ে। এছাড়া আছে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীনে ম্যান্ডারিন-মাঞ্চুরিয়ান বিরোধও।
অসমে বাংলা ভাষার লড়াই : বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের একটি রাজ্য অসমে বাংলা ভাষাভাষী আছেন। এক সময় বাংলা ও অসম একই ভূখ- বিবেচিত হতো। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের আন্দোলন ও রক্তদানের পর বাংলা ভাষা নিয়েই মাতৃভাষার সবচেয়ে বড় আন্দোলন ও রক্তদানের ঘটনাটি ঘটে অসমে। অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল অসম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যেহেতু ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী সেহেতু পাকিস্তানের বাঙালিদের মতো অসমের বাঙালিরাও অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে রাস্তায় নামে। এই গণআন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে, সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ফলে বাংলা ভাষা আবারও বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত হয়।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০,০০০ বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০,০০০ বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। এ উপলক্ষে ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।
১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক রণেন্দ্র মোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি সংখ্যাধিক্যের বলে বিধানসভায় গৃহীত হয়।
বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন। বরাকের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল, ১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয, ১৯ মে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরীকে (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) গ্রেপ্তার করে।
১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকাল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০-এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয়নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকেলে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল প্রায় ২:৩০-এর সময় নয়জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল। পিকেটিংকারী সকলে তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালকসহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর কোনো অশনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে।
এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউন্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে নয়জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দুজন পরে মারা যান। ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোক মিছিল করে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। আরও একবার বিজয়ী হয় বাংলা ভাষা। এরপর শিলচর রেল স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন নামকরণ করা হয়। সেখানে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২০১১ সালে অসমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মূর্তি স্থাপন কমিটির পক্ষ থেকে গোপা দত্ত আইচ ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে কমলার একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন। এই আন্দোলনে যারা শহীদ হন তারা হলেন কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। এছাড়াও অসমেই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বিজন চক্রবর্তী নামের আরও একজন শহীদ হন। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই শহীদ হন দুজন : জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস।
দক্ষিণ ভারতে মাতৃভাষা আন্দোলন : দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয় ১৯৩৭ সালে।
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে রাজনীতিবিদ রাজাগোপালাচারীর অধীনে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। সে সময় স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে একই ভাষা প্রচলন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে পুরো ভারতে হিন্দি ভাষার প্রচলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজাগোপালাচারী সর্বপ্রথম তামিল স্কুলগুলোয় বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে হিন্দি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তামিলরা। কারণ দক্ষিণ ভারতে হিন্দির অনুপ্রবেশ মানে দীর্ঘমেয়াদে উত্তর ভারতের আধিপত্যের কাছে মাথানত করা।
১৯৩৮ সালের ৩ জানুয়ারি রাজাগোপালাচারীর বাসভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হয়ে এ পরিকল্পনা বাতিলের দাবি জানায়। আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে ১২৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মাধ্যমে শুরু হয় কয়েক দশকব্যাপী চলতে থাকা তামিলদের হিন্দি আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনের। এতেও থেমে থাকেনি সরকার। বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমে একে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তামিলদের আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
১৯৩৯ সালে দুই আন্দোলনকারী পুলিশি হেফাজতে মারা গেলে আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। অবশেষে তুমুল আন্দোলনের মুখে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি সরকার হিন্দিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর সিদ্ধান্ত বাদ দেয়। অবশ্য কংগ্রেস সরকার শুধু সাময়িকভাবে পিছু হটেছিল। একবারে ক্ষান্ত হয়নি।
১৯৪০ সালে আইনটি তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে তুলে নেওয়া হয়। এতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার নাখোশ হলেও স্থানীয় আন্দোলন শেষ হয়। আমাদের জানা মতে ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার শুরু সেই ঘটনাতেই।
ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
www.bijoyekushe.net
www.bijoydigital.com