ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

জি-২০ সম্মেলন ও প্রাপ্তি

ড. মো. জামাল উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জি-২০ সম্মেলন ও প্রাপ্তি

ড. মো. জামাল উদ্দিন

ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিধর দেশের সমন্বয়ে গঠিত ‘জি-২০ (গ্রুপ অব টুয়েন্টি (এ-২০) এর ১৮-তম সম্মেলন’। এ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার অতিথি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। সম্মেলনের প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিন্ন ভিন্ন অধিবেশনে যোগ দেন। শীর্ষ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘ওয়ান আর্থ, ওয়ান ফ্যামিলি, ওয়ান ফিউচার’ শীর্ষক দুটি বক্তৃতা প্রদান করেন।
‘ওয়ান আর্থ’ ও ‘ওয়ান ফ্যামিলি’ সেশনে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, ইউরোপে যুদ্ধের ফলে জ্বালানি, খাদ্য ও সারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা তুলে ধরেন। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের মেয়াদকালে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য সাফল্যের অভিজ্ঞতা বিশ্বনেতাদের কাছে উপস্থাপন করেন। একইসঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো অ্যাঞ্জেল ফার্নান্দেজ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একটি বিভক্ত ভূরাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে চাপা বৈশ্বিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির শীর্ষ নেতাদের এ শীর্ষ সম্মেলন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩  দুদিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিনে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন সদস্য দেশগুলোর নেতারা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে চলমান সম্মেলনে এমন অসামান্য ঐকমত্য সবার জন্যই বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা মারাত্মক দুরূহ হয়ে উঠেছিল। এমন সময় এ ঐকমত্য বেশ গুরুত্ব বহন করে। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বসুবৈব কুটুম্বকম’। সংস্কৃত এই শব্দ দুটির অর্থ ‘পুরো বিশ্ব, একটি পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। মানুষ, প্রাণি, উদ্ভিদ ও অণুজীবসহ সব জীবনের মূল্য, পৃথিবী ও বিস্তৃত গ্রহে তাদের আন্তঃসম্পর্ককে কেন্দ্র করে এজেন্ডাটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ পুরি বলেন, জি-২০’র দিল্লি ঘোষণায় মোট ৭৩টি সমঝোতা এবং ৩৯টি সংযুক্ত নথি রয়েছে, যা আগের সম্মেলনগুলোর তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তা, ঋণ সমস্যা ও জলবায়ু বিষয়ে নীতি সমন্বয় হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সম্মেলনের জন্য জড়ো হওয়া সমস্ত দেশ বিশ্বজুড়ে শান্তি নিশ্চিত করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে তিনি ‘বিশ্বব্যাপী বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে খাদ্য ও সার সংকটে ফেলেছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতিতে ভুগছে, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একসঙ্গে চলতে হবে।’ উদ্বোধনী দিনে আফ্রিকান ইউনিয়নকে জোটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। 
এ সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল টেকসই উন্নয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং প্রবৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং বৈষম্য, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সম্মেলনে স্থান পায়। ১৯৯৭ সালে এশিয়ান আর্থিক সংকটের পটভূমিতে ১৯৯৯ সালে জি-২০ গঠিত হয়েছিল। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল এশিয়ার অনেক দেশ। এ সংকট শেষে ১৯৯৯ সালে বিশ্বের বড় ২০টি দেশ একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলে। সেটিই মূলত জি-২০, যা একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ফোরাম।

এটি বৈশ্বিক স্থাপত্য গঠন ও শক্তিশালীকরণ আর আন্তর্জাতিক অর্থনীতি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দুটি উদ্দেশ্যে জোটটি কাজ করে থাকে। একটি অর্থনৈতিক আর অন্যটি শীর্ষ সম্মেলনের আগে কূটনৈতিকদের প্রস্তুতিমূলক কাজ। অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা দিকগুলোর নেতৃত্বে থাকেন। অর্থনৈতিক দিকগুলো ঠিক হওয়ার পর কূটনীতিকরা বিভিন্ন নীতি ঠিক করেন।
সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার পাশাপাশি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দুই নেতা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য এবং সংযুক্তি, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং জনগণের মেলবন্ধনসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে দুই দেশের সহযোগিতা নিয়েও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানান, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আর্থিক লেনদেনের পথ সুগম করা, কৃষি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়ে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার এবং ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন চালু করার চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (সেপা) বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে আগ্রহী। ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশের ভারত-মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানিয়েছে। ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়বে কিনা বাংলাদেশ, সে বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও ভারতের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করতে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সংযুক্তি তথা রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতেও দুই প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন।’

চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর ব্রাজিলের কাছে জি-২০ এর সভাপতিত্ব হস্তান্তর করবে ভারত। সে অনুযায়ী পরের বছরের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ব্রাজিলে। সম্মেলনের সারসংক্ষেপে বলা হয়, বেশিরভাগ সদস্য ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্র নিন্দা করেছে। জোর দিয়ে বলেছে যে, এই যুদ্ধ মানবিক দুর্ভোগের কারণ এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদ্যমান ভঙ্গুরতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এটি সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, আর্থিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি এবং অব্যাহত শক্তি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। তাই ধনীদেশগুলোর প্রতি পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করে একটি শান্তিময় বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে উঠুক, সেই প্রত্যাশা সবার।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, 
এফএও- জাতিসংঘ

×