ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজুল আলম খান

প্রকাশিত: ২১:২৭, ১০ জুন ২০২৩

সিরাজুল আলম খান

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে বিবেচিত বর্ষীয়ান রাজনীতিক সিরাজুল আলম খান চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে। শুক্রবার দ্বিপ্রহরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার (ইন্না লিল্লাহি .... রাজিউন)। অকৃতদার সিরাজুল আলম খান জীবনের প্রায় পুরোটাই পদচারণা করেছেন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। অবশ্য গত প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি রাজনীতিতে এক প্রকার নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তবে এমন জোর গুঞ্জনও আছে যে, স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক পালাবদল ও মোড় পরিবর্তনে নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নেপথ্যের এই ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নিজে কখনো কিছু বলেননি, এমনকি কোনো নেতা বা ব্যক্তিও এই বিষয়ে আলোকপাত করেননি।

স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে জীবনের বহুলাংশ কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। জনসম্মুখে আসতেন না বললেই চলে। টেলিভিশনে টক শোতে অংশগ্রহণ কিংবা লেখালেখিতেও তেমন ভূমিকা ছিল না। মৃত্যুর আগে ঘনিষ্ঠ স্বজনদের বলে গেছেন, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোক সভা হবে না। শহীদ মিনারে নেওয়া হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব দাফন করতে হবে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে।’ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য সরকার প্রদত্ত গার্ড অব অনার সম্পর্কেও কিছু বলেননি। সিরাজুল আলম খানের এই অন্তিম ভাষ্য কি নিছক অভিমানবশত নাকি অন্য কোনো কারণে, তা আর কোনোদিন জানা যাবে না তার লাশ সমাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ফলে, আড়ালেই থেকে যাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক অনালোচিত ও অনুদ্ঘাটিত তথ্য, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। 
ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত হয় বহুল আলোচিত ‘নিউক্লিয়াস’, যার মূল পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারী ছিলেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফার সমর্থনে ব্যাপক জনমত গঠন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র এবং শ্রমিকদের ব্যাপক সম্পৃক্তকরণে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করায় তিনি তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পালন করেন অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা। তিনি ছিলেন বিএলএফের সংগঠক।
স্বাধীনতাপরবর্তী সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির চরম বিরোধের জের ধরে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে ১৯৭২ সালে গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। জাসদ নেতাদের কাছে তিনি তাত্ত্বিক গুরু ও দাদাভাই নামে সুপরিচিত। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য চরম অস্বস্তির সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে  তৈরি হয় দূরত্ব ও বিরোধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট রচনায় জাসদের ভূমিকার বিষয়টি বহুল আলোচিত। চিরদিনের অমীমাংসিত বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ রেখেই শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন সিরাজুল আলম খান। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন। আমরাও তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং স্বজনদের জানাই গভীর সমবেদনা। 

×