.
নানামুখী চাপের মধ্যে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ১ জুন ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব সংসদ অধিবেশ পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ করার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। নতুন বাজেট চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় এক লাখ এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বা ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আগামী বছরের বাজেটে ব্যয়ের অঙ্ক যেমন বড়, তেমনি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বৃহৎ, যেখানে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ কোটি টাকা ধরার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশাল অঙ্কের এ রাজস্ব আদায়ে নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক-কর বা ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের চাপ থাকছে। থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও। তবে এসব সংস্কারের সঙ্গে আইএমএফের শর্তের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে কিছু বলেননি অর্থমন্ত্রী। এমন পরিস্থিতিতে জনতুষ্টিমূলক বাজেট কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ছয় হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর জোগান দেবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আসবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) থাকছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্প ১ হাজার ৩০৯টি, বরাদ্দ বেড়েছে ২৬ হাজার ৪৩৯ কোটি। তার মধ্যে ১০টি প্রকল্পে বরাদ্দ ৬০ হাজার কোটি টাকা ইত্যাদি। আসন্ন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ। এটা মোট বাজেট ব্যয়ের ১৬.৫৭ শতাংশ, জিডিপির ২.৫২ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি, ভর্তুকি বাবদ থাকছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য খাতে ৭৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করেছেন এমন একটি সময়ে যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন জটিল হয়ে উঠেছে। গত (নভেম্বর ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৩) ছয় মাসের সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ৮.৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই মূল্যস্ফীতিকে ৬.৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যখন মুদ্রানীতির মাধ্যমে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমানোর পথে সরকার, তখন অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের মোট বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন জিডিপির ৩৩.৮ শতাংশ। এর মধ্যে আইএমএফ সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে বর্তমান জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ। আইএমএফ বলেছে, স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে আগামী অর্থবছরে যাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ০.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় বাড়ে। সেই লক্ষ্যে এনবিআরকে বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে এসব বিষয়ে ইতিবাচক ও আশাবাদের কথা তুলে ধরেছেন। এনবিআর জানায়, শুধু আইএমএফের শর্তের কারণে নয়, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সরকারের চেষ্টা আগে থেকেই আছে। আগামী অর্থবছরে সেই চেষ্টা ত্বরান্বিত হবে। এদিকে ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহের দুটি উৎস খাত চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে কোন উৎস থেকে কত টাকা ঋণ করবেন, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থমন্ত্রী মোট এক লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন, যা মোট ঘাটতি অর্থায়নের ৫৭.৬৮ শতাংশ। এই পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ আসবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে আসবে ২৩ হাজার কোটি টাকা, বাকি এক লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা আসবে বিদেশী ঋণ থেকে। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বাজেটের ১২.৩৮ শতাংশ অর্থাৎ, ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছর এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। সুদ পরিশোধ খাতগুলোর মধ্যে সরকারের যে অভ্যন্তরীণ ঋণ রয়েছে, তার সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ৮২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের খাতগুলোর মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাতে ব্যয় হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি বিল-বন্ডের সুদে যাবে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জিপিএফ খাতের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হবে আট হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ রাখা হয় ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, এই ভর্তুকির বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিদ্যুতে, যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষিতে যাবে ১৭ হাজার কোটি, রপ্তানিতে যাবে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি এবং প্রণোদনায় ব্যয় হবে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভর্তুকিতে ব্যয় হবে আরও ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এখন আসা যাক প্রত্যাশা পূরণের চাপ রয়েছে বাজেটে। কারণ, নির্বাচনী বছর বাজেটে নানা রকম জনপ্রত্যাশা থাকে, এটাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা রয়েছে ও যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের চাপ, সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ, আর্থিক খাতের সংস্কার, বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়, বিদ্যুতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান, ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা ঋণ নেওয়ার বিষয় এবং একই সঙ্গে বিপুল অঙ্কের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন। তবে সরকার আশাবাদী, যত প্রতিকূলতাই আসুক সব কিছু জয় করতে বদ্ধপরিকর।
সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে। যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে। সবাই প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে। ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি। যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা সবকিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে। ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সব কিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ এগুলো করা সম্ভব হবে এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ চলছে। চলছে চতুর্থ বিপ্লবের সময়কাল। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি, কারখানার উৎপাদন, কৃষিকাজসহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম ও বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই, প্রস্তুতি চলছে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির। কিন্তু স্মার্ট যন্ত্র ও প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদেরও চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিতে হতে হবে স্মার্ট। আমরা যেমন বলি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, তেমনই শেখ হাসিনার জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ জাতি চোখে দেখত না।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের চালিকাশক্তি হিসেবে তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করে তোলার উদ্দেশ্যে গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কাজে আগামী বাজেটে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। স্মার্ট বাংলাদেশে ৩ শতাংশের কম মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে এবং বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপর এবং বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। স্মার্ট বাংলাদেশে শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে সবার দোরগোডায়।
স্বযংক্রিয যোগাযোগব্যবস্থা, টেকসই নগরায়ণসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয সব সেবা হাতের নাগালে থাকবে। এছাড়া তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, গত দেড় দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ,
সিটি ইউনিভার্সিটি