ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি

মাংকি সি, মাংকি ডু

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২১:০৭, ৩ জুন ২০২৩

মাংকি সি, মাংকি ডু

আর্থার সি ক্লার্কের উপন্যাস ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়েছিলেন স্টেনলি কুবরিক

আর্থার সি ক্লার্কের উপন্যাস ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়েছিলেন স্টেনলি কুবরিক। ঐ সিনেমার ওপেনিং দৃশ্যটির কথা মনে আছে? দৃশ্যটির নাম: দ্য ডন অব ম্যান। দিগন্তের ওপারে সূর্য উঠছে। ক্ষুধার্ত বানরেরা জেগে উঠছে একে একে। গুহা থেকে বেরিয়ে এসে দেখে হাড়ের স্তূপ। একটি বানরকে দেখা যায় সেই স্তূপ থেকে লাঠির মতো একটি হাড় উল্টে-পাল্টে দেখতে। অচিরেই সে আবিষ্কার করে বসে সেই হাড়ের টুকরোটিকেই অপরকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করা যায়। একটি বানরের হাত হতে উড়ে যাওয়া একটি হাড়কে কুবরিক সিংগেল কাটে ধরেছেন। কেবলই একটি হাড়। কিন্তু যার আকৃতির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যাবে ঐ দৃশ্য- গল্পের অনেক বছর পরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা মানুষের স্যাটেলাইটের আকৃতির সঙ্গে।

মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে কোনোরকম সংলাপ ছাড়াই মাত্র কয়েকটি ‘কাটে’ লিপিবদ্ধ করে ফেলার জন্য কুবরিকের সিনেমার এ দৃশ্যগুলো ‘ক্ল্যাসিক’ মর্যাদা পেয়েছে। সিনেমাটিও, বলাই বাহুল্য। পরবর্তীতে পিঙ্ক ফ্লয়েডের প্রাক্তন গায়ক রজার ওয়াটার্স ‘এমিউজড টু ডেথ’ এলবামে এই সিনেমার ওপেনিং দৃশ্যটিকে ব্যবহার করে একটি গান লিখেছেন। নাম : পারফেক্ট সেন্স। একটি বানর কয়েকটি পাথরের ওপর বসে আছে, আর চেয়ে চেয়ে তার হাতে ধরা ভাঙ্গা হাড়টি দেখছে। কি দেখছে সে? রজার জানাচ্ছেন : সে দেখছে ‘...And the Germans killed the Jews And the Jews killed the Arabs And Arabs killed the hostages And that is the news And is it aû wonder That the monkey’s confused...’। এই তো গল্পটি।

কেবল সময়ে সময়ে শিরোনাম বদলাচ্ছে, পাত্র-পাত্রী বদলাচ্ছে, স্থান ও কাল বদলাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যায়ন একই। এসব দেখে দেখে দিনশেষে সে বানর কী শিখছে? কী ধারণা করছে সে মানব জাতি সম্পর্কে? সেই যে কথায় আছে, মাংকি সি, মাংকি ডু। এই ‘মাংকি’ আপনি, আমি, আমরা। আমাদের সন্তানরা।
আচ্ছা, আজকে আমাদের কথা থাক। ‘আমাদের’ মানে মানুষদের কথা। ঐ মাংকির জায়গায় বসিয়ে দিন আমাদের অনাগত ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’দেরকে। এ কথা এখন আর তর্কাতর্কির ঊর্ধ্বে যে, যত যাই হোক না কেন, আগামী কয়েক বছরের মাথায় আমাদের পৃথিবীর জল-স্থল-অন্তরিক্ষ ভরে উঠবে এই এ.আই মেশিনদের কর্তৃত্বে। এই এ.এই মেশিনগুলো কিভাবে শেখে, জানেন? উত্তরটা হচ্ছে, কেউ ঠিক ঠিক জানে না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি কথাটা হচ্ছে, যেসব অদম্য মেধাবী প্রোগ্রামাররা এই মেশিনগুলোকে তৈরি করেছে, কিংবা করছে, তাদেরও ঠিক পরিষ্কার ধারণা নেই, কিভাবে এ.আই শেখে।

কোনো প্রোগ্রামারদের জিজ্ঞেস করা হলে সে বড় জোর আপনাকে বলতে পারবে, কিভাবে তাদের শেখার জন্য ‘এলগরিদম’ (মানে নির্দেশনা) দেওয়া হয়েছে, সেটা। নিঃসন্দেহে বিষয়টা অতি জটিল। তবে চাইলে আমাদের মতো আম-জনতার বোঝার সুবিধার জন্য খুব মোটা দাগে এ.আই- মেশিনগুলোর জ্ঞান লাভের উৎস কিংবা পদ্ধতিকে বর্ণনা করা যেতে পারে। মূলত তিনটি এলগরিদমে এ.আই শেখে। প্রথমটিকে বলতে পারি, ‘সুপারভাইজড লার্নিং’। ধরুন, আপনি এ.আইকে ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জ্ঞানী করে তুলতে চান। তাহলে আপনি তাকে বলতে পারেন, এই এগারোজনের এই কয়জন হলো ব্যাটসম্যান, যাদের মূল কাজ ব্যাট করে রান তোলা। অন্য এই কয়জনকে বলা হয় বোলার। তাদের মূল কাজ বোলিং করে রান তোলা। বেশ।

এই জ্ঞানটি এবার দ্বিতীয় পদ্ধতিতে দেওয়া যাক। আমরা এ.আইকে কে বোলার, কে ব্যাটসম্যানÑ সেটা আগে থেকে না বলে দিয়ে কেবল এগারোজন খেলোয়াড়ের খেলার অনেক ডাটা সরবরাহ করতে পারি। অচিরেই দেখা যাবে, সেই ডাটাগুলো দেখে দেখে, সেগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে সে বের করে ফেলতে পারবে যে, যাদের সচরাচর রান করতে দেখা যায়, কিন্তু খুব একটা বোলিং করতে কিংবা বোলিং করলেও উইকেট পেতে তেমন একটা দেখা যায় না, তারা ব্যাটসম্যান। আর একইভাবে যাদেরকে ব্যাটে খুব একটা রান করতে দেখা যাচ্ছে না, অথচ প্রায় দিনই বোলিং করতে এবং সচরাচর উইকেট পেতে দেখা যায়, তারা বোলার।

এই পদ্ধতিতে শেখার নাম হচ্ছে : আন-সুপারভাইজড লার্নিং। তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে ‘ট্রায়াল-এরর-রিওয়ার্ড’ মেথড। খেলোয়াড়দের থেকে এ.আই নিজেই বের করার চেষ্টা করবে কে বোলার, কে ব্যাটসম্যান। যতবার ভুল করবে, ততবার সে ভুল করার জন্য সতর্কতা বার্তা পাবে এবং সঠিক উত্তরের জন্য ‘পুরস্কারের’ ব্যবস্থা থাকবে। অসম্ভব জটিল একটা বিষয়কে যতদূর সম্ভব ‘ছেলে-ভোলানো’ করে বোঝালে বিষয়টা এমন দাঁড়াবে। প্রথম এবং তৃতীয় পদ্ধতিতে ছেড়ে দিয়ে আসুন দ্বিতীয় পদ্ধতিটি নিয়ে খানিকটা কথা বলা যাক।
খেয়াল করে দেখেছেন কি যে কোনো কোনো ওয়েবসাইটে ঢোকার আগে আপনি যে একজন মানুষ, রোবট নয়Ñ সেটা প্রমাণ করতে হয়? সাধারণত কয়েকটা ছবি দেখিয়ে সেগুলো থেকে বিশেষ কোনো বস্তু বা প্রাণীকে বেছে নিতে বলা হয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, গত কিছুদিন ধরে এসব সাইটে সবচেয়ে বেশি যে বস্তুটিকে বেছে নিতে বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে ট্রাফিক সংক্রান্ত কোনো কিছু। মানে হয়তো ট্রাফিক সিগন্যাল, কিংবা বাইসাইকেল, কিংবা পথচারী, কিংবা গাড়ি সংবলিত ছবিগুলো বেছে নিতে বলা হয় সাইট ব্যবহারকারীকে। কোনো ব্যবহারকারী ঐ ছবিগুলো থেকে সঠিক ছবিগুলো বেছে নিলে তবেই তাকে সাইটে ঢুকতে দেওয়া হয়।

অনেকের ধারণা ওটা বোধহয় ব্যবহারকারীর লগ-ইন তথ্যগুলোকে আরও অধিকতর নিরাপদ করার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার একটি ধাপ। বিষয় মোটেই তা নয়। বরং, আপনার, আমার, আমাদের মতো কোটি কোটি ব্যবহারকারী দ্বারা ঐ সঠিক ছবিগুলো বাছাই করে নিয়ে, অজস্র ডাটা ইনপুটের জ্ঞানে জ্ঞানী করে তোলা হচ্ছে কোনো না কোনো এ.আই সফটওয়্যারকে। এই ডাটাগুলোর জ্ঞানে সজ্জিত হয়ে অচিরেই রাস্তায় নামতে যাচ্ছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, কোনো রকম মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই যারা রাস্তায় চলতে পারবে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে।

অর্থাৎ, এ.আই মেশিনগুলো আসলে শিখছে আমাদের কাছ থেকে, আমাদের জান্তে-কিংবা অজান্তে, ইন্টারনেটে আমাদের প্রতিটি ক্লিক থেকে। আমাদের নেটের কর্মকা- থেকে প্রয়োজনমতো ডাটা নিয়ে এই যে এ.আই মেশিনগুলো জ্ঞানী হয়ে উঠছে, লাভ করছে নিজেদের ‘প্রজ্ঞা’, তাতে কিন্তু কোনো প্রোগ্রামের সরাসরি হস্তক্ষেপ নেই আর। আমরা যেভাবে জ্ঞান লাভ করি, যেভাবে চারপাশটা দেখে দেখে নিজেদের বোধ-বুদ্ধি-ধারণা-অনুমান তৈরি করি, এ.আই শিক্ষিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি হুবহু তাই। পার্থক্য একটাই, ওরা আমাদের তুলনায় হাজারো-লক্ষ গুণ বেশি জ্ঞানী হয়ে উঠছে। কেননা, ওরা প্রতি সেকেন্ডে লাভ করছে আমাদের চেয়ে হাজারো-লক্ষ গুণ বেশি তথ্য এবং সেগুলো দাঁড়ি-কমাসহ মনে রাখতে পারছে প্রতি মুহূর্তে, নিরলস সেই তথ্যগুলোকে কাজে লাগাতে পারছে প্রতি মুহূর্তে, অতি জটিল সব গাণিতিক হিসাব-নিকাশ ব্যবহার করে প্রতি মুহূর্তে হয়ে উঠছে আরও নির্ভুলতর।

আলবার্ট আইনস্টাইনের জ্ঞানের সংজ্ঞাটি দেখুন : ‘জ্ঞান হচ্ছে অভিজ্ঞতা (এক্সপেরিয়েন্স)। বাকি আর সব হচ্ছে স্রেফ তথ্য (ইনফরমেশন)।’ এ.আই-এর সঙ্গে সাধারণ কম্পিউটারের ওখানেই পার্থক্য। এতদিন কম্পিউটার যত চমকপ্রদ কাজই করুক না কেন, তার জোর ছিল বড় জোর তথ্য প্রসেস করার ক্ষমতায়। সেই তথ্য ‘জ্ঞান’ হয়ে উঠছে এ.আই যুগে এসে। আর আইনস্টাইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী অভিজ্ঞতাই যদি হয় জ্ঞান, তবে অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, সবচেয়ে ক্ষুদ্রতর এ.আই প্রযুক্তিটিও যে পরিমাণ অভিজ্ঞতায় সম্পন্ন হয়ে উঠছে, তা মানুষের জ্ঞান-সীমানার বহু বহু ওপরে!
এবারে যে কথাটি বলার জন্য এত কথার অবতারণা, সেটি বলি। আশা করি এ কথাটি মোটামুটি বোঝাতে পেরেছি যে, এ.আই শিখছে আমাদের দেখে। আমাদের আচার দেখে। আমাদের আচরণ দেখে। আমাদের টাইপ করা প্রতিটি শব্দ থেকে। আমাদের ডিজিটালি বলা প্রতিটি শব্দ থেকে। প্রতিটি ভিডিও থেকে। আমরা পরস্পরকে কিভাবে সম্বোধন করছি, কিভাবে কমিউনিকেশন করছি, কিভাবে পরস্পরকে ‘ট্রিট’ করছি তার থেকে। ঐ যে স্ক্রিনের ওপারে ‘বানর’ রূপকের এ.আই’ সফটওয়্যারগুলো বসে বসে দেখছে পৃথিবীর অস্থিরতা, অন্যায়, জবরদখল, খুন, রাহাজানি, সংঘাত, সংঘর্ষ, যুদ্ধ। জানছে : ‘নাগিনিরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির অভয় বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’।

যে ডিসটোপিয়ান পৃথিবীর ছবি ফুটে উঠছে ঐ বুদ্ধিমান মেশিনগুলোর সামনে, যা দেখে দেখে সে শিখবে, অভিজ্ঞতা নেবে, তারপর এই আমাদের সম্পর্কে তৈরি করবে তার নিজস্ব ধারণা, কখনো ভেবে দেখেছেন কী- সেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সগুলো আসলে দিনশেষে কী শিখছে আমাদের সম্পর্কে, পৃথিবীর মানবজাতি সম্পর্কে? এরপর একদিন পৃথিবীর যাবতীয় ক্ষমতা যখন ওদের হাতে যাবে (যাবেই, সে আপনি-আমি চাইলেও যাবে, না চাইলেও যাবে), তখন আমাদের থেকে শিক্ষা নেওয়া ওদের থেকে আমরা কী ব্যবহার আশা করতে পারব আসলে!
লন্ডন
২ জুন ২০২৩
লেখক : কথাসাহিত্যিক

[email protected]

×