ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

প্রবাসে বিক্ষিপ্ত ভাবনা

শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

প্রবাসে বিক্ষিপ্ত ভাবনা

ফাইনাল ওয়াল্ডকাপ

গত সপ্তাহে একটা কানাডিয়ান গ্রোসারিতে গিয়েছি চট জলদি একটা পাউরুটি কিনতে। সঙ্গে খাবারের ভিন্নতায় চোখ বোলাচ্ছি যদি অন্য কিছু কেনার থাকে। আমার পাশেই তখন এক বাবা আর ছেলে কেনাকাটা করছিল। তারা বাংলায় কথা বলছিল। ছেলেটি বাবাকে একটা জুস দেখিয়ে কিনে দিতে বলছিল। বাবা মোটামুটি তার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘এইটা খারাপ জুস, ভালো না। এটা খায় না।’

আমার কেনাকাটা শেষে আমি চলে এলাম। তিন চারদিন আগের কথা। ভুলেও গেছিলাম। আজকে সকালে অহনাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসার সময় আবার ঘটনাটি মনে পড়ল। নানা কিছু চিন্তা করছিলাম। গাড়িতে স্পটিফাই থেকে গান বাজছিল, ভাবছিলাম আইয়ুব বাচ্চুর কথা। তার আরও বহু বছর বেঁচে থাকা খুব স্বাভাবিক ছিল, তাহলে হয়ত তারকাদের নানা অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত। কত শত চিন্তার নানা অলি-গলি পেরিয়ে সেই বাবা ও ছেলের কথা মনে পড়ে গেল।

আবছাভাবে মনে পড়ছে ভালো-খারাপ নিয়ে ভাবছিলাম। নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল আমাদের সমাজে যেকোনো জিনিসকে খুব দ্রুত ‘খুব ভালো’ কিংবা ‘খুব বাজে’ বলে দেওয়ার চল আছে। আমরা যে কোনো কিছুকেই ‘ফালতু’ বলে উড়িয়ে দিতে পারি গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই। ভাবছিলাম ওই বাবার কি উচিত হয়েছিল ছেলেটিকে কোনো সুর্নিদিষ্ট কারণ না দেখিয়েই বলা যে জুসটা খারাপ! এটি খুব স্বাভাবিক, এমনটা আমরা অনেক অভিভাবকই করি।

সন্তান বাজারে গিয়ে কিছু চাইলেই, এটা ভালো না বা ওটা খুব খারাপ এই ধরনের একটা ‘রায়’ ঘোষণা করে দিই। আমি জানি না ওই বাবা কেন ছেলেটিকে জুস কিনে দিতে চাননি। কিন্তু এটা অবশ্যই একটা কারণ হতে পারে যে তিনি জুস আসলে যে খুব উপকারী খাদ্যদ্রব্য না সেটা ইঙ্গিত করেই কথাটি বলেছেন। কিন্তু জুসটা খুব খারাপ বললে সেটি কেন খারাপ সেই কারণটি জানালে সন্তানটি হয়ত যৌক্তিকভাবে এর অপ্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সন্তুষ্ট হতো।

যেমন বলা যেত, এই জুসটা ভালো না কারণ এতে অনেক চিনি আছে কিংবা এতে অনেক বেশি ক্যালোরি অথবা এর ভেতর অনেক রাসায়নিক দ্রব্যাদি আছে যা শরীরের ক্ষতি করে কিংবা এর মধ্যে আসল ফলের উপাদান নেই বললেই চলে, আছে শুধু ফলের গন্ধ সৃষ্টিকারী কৃত্রিম উপাদান। তারপর হয়ত ছেলেটিকে বলা যেত, তুমি যদি চাও আমি তোমাকে এই জুসটির পরিবর্তে তাজা আম বা কমলা কিনে দিতে পারি যার স্বাদ জুসের কাছাকাছি হবে কিন্তু তোমার শরীরের জন্য ভালো। এই পুরো বিষয়টি ভালো করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলে শিশুটির মধ্যে একটি চমৎকার যুক্তি বোঝার সামর্থ্য তৈরি হতো।
কিংবা জুস না কিনে দেওয়ার পেছনে যদি অর্থনৈতিক কারণ থাকে, তাহলে তাকে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, বাবা দেখ এই মুহূর্তে এটি কেনার মতো আর্থিক অবস্থা আমার নেই। তাই কিনে দিতে পারছি না। কিংবা দেখ বাবা তুমি গত কয়েকদিনে বেশ কিছু জুস বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়েছ যা শরীরের জন্য ভালো নয়।

কারণ এতে আছে অনেক বেশি শর্করা ও চিনি, যা কম করে খেলে তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে। এই যে বাবা ও ছেলে কিংবা মেয়ে অথবা মায়ের মধ্যে আলাপন, সেটি তাদের মধ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্যতার পরিবেশ তৈরি করবে। সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে বড় হলে খুব বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া থেকেও রক্ষা করবে।
এ বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্ধু তাসলিমা তাহের লিনা বলল, ‘কিছুদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার মেয়ের দুজন বন্ধু বাসায় খেলতে এসেছে। ওরা দুই ভাই। আমি যখন ওদের জন্য নাস্তা তৈরি করছিলাম তখন আমার মেয়ে হঠাৎ করে আমাকে বলল, মা-ওরা কিন্তু এখন আর জুস খায় না। আমি যেহেতু ওদের অনেক দিন ধরেই চিনি এবং প্রায় প্রতি বেলার খাবার সময় তাদের জুস খেতে দেখেছি, তাই বেশ অবাক হলাম।

পরে ভাবলাম নিশ্চয় ওর বাবা-মা জুসে চিনির আধিক্যর জন্য তাদের সেটি খেতে নিষেধ করেছে। আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের দাঁতের ডাক্তার কি তোমাদের কোনো চিনি খেতে মানা করেছে? ওরা বলল, না আমাদের মা বলেছে অর্থনৈতিক মন্দার জন্য আমরা আর জুস খেতে পারব না। আমাদের বাবা-মা আর জুস কেনার সামর্থ্য রাখেন না।’ লিনার কথা আমাকে দুটো জিনিস নিয়ে ভাবাল। প্রথমত শিশুদের সঙ্গে সুন্দর করে যৌক্তিক আলোচনা করলে তারা সেটা গ্রহণ করতে সক্ষম।

দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাবা-মার আর্থিক ক্রয়ক্ষমতা কোন পর্যায়ে কমলে তারা সন্তানকে আর জুস কিনে দিতে পারেন না! এটি আমাদের দেশের মানুষেরও অনুধাবন করা উচিত। এই ঘটনা যে শুধু ওই বাবা ও ছেলের মধ্যেই হয়েছে তা নয়, ঘটনাটি আমাকে চিন্তা করতে ও সে বিষয়ে আমার মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করেছে। এটি আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। আমরা এত চিন্তা ভাবনা করে সবকিছু করি না এবং সাধারণত বেড়ে ওঠার সময় যা দেখি আশপাশে, তাই করে থাকি।
এই যে অবিবেচকের মতো কোনো কিছুকে ভালো বা মন্দ বলে দেওয়া, সেটি আমাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের চারপাশে তাকালে দেখছি ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উগ্র আচরণ, সহিংস কর্মকা-। আমরা এটিকে বিশ্বকাপের মজা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যেটি আসলে ঠিক নয়। হাল্কা রসিকতার সঙ্গে অগভীর আচরণ, সামান্য মজা কিংবা প্রতিহিংসাকে বন্ধুত্ব বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং সুচিন্তিত, গভীর চিন্তা ও ভালো পরামর্শকে আতলামি বলে ভাসিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা তার প্রভাব সমাজে সর্বত্র দৃশ্যমান।

সবকিছুতে দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার যে সামাজিক অবস্থান আমাদের, তার একটা বড় কারণ শৈশব থেকে যৌক্তিক আচরণ না দেখার নেতিবাচক প্রভাব। মনে হয় আমাদের সন্তানদের বড় হবার সময় তাদের সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয়, তাতে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা থাকা উচিত। বাবা আমি কি শুক্রবারে বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে যেতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তরে অযাচিতভাবে ‘না যাওয়া যাবে না, ভদ্র ঘরের মেয়েরা ছুটির দিনে ঘর থেকে বের হয় না’-  এই ধরনের পক্ষপাতমূলক মন্তব্য করা কি ঠিক? এই এক লাইনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সন্তানদের ছুটির দিন, ভদ্র ঘরের সন্তান ও মেয়েদের জীবন নিয়ে তিনটি দিকনির্দেশনা দিয়ে দিচ্ছি কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই।

একই কথা হয়ত আমরা এভাবেও বলতে পারতাম, দেখ আমরা সপ্তাহে একটা দিনই সবাই বাসায় থাকি। আমার প্রত্যাশা ছিল আমরা একসঙ্গে খাব, ঘুরব বা গল্প করব। তাই আমি চাই তুমি এই ছুটির দিনটা আমাদের সঙ্গে কাটাও। কিংবা আমি রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, চলো আলাপ করা যাক কিভাবে তুমি নিরাপদে সেদিন বাইরে কাটাতে পারো। অথবা এটা তো বাবা একদম হঠাৎ করে জানালে, আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। এরপর থেকে তোমরা কোনো পরিকল্পনা করলে যদি অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে জানাও তাহলে আমাদেরও প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়।
এই বিষয়গুলো সহজ নয়। কিন্তু একটা চলমান প্রক্রিয়া। শেখার প্রথম ধাপ হচ্ছে যুক্তি বোঝার চেষ্টা করা। একটা যৌক্তিক আলাপ কিংবা লেখার সারবস্তু মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই বরং মাহাত্ম্য আছে। আমি তো ওই বাবা ও ছেলের কথোপকথনের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এটি আমাকে একটা ভালো বিষয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে অহনার সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষেত্রেও সাহায্য করবে। যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, যে যুক্তিটি আমি দিতে চাই সেটি না দেওয়ার ইচ্ছা বা সময়ের অভাবে যেন কোনো জিনিসকে আমি খারাপ বা ভালো না বলে দিই। যে জিনিসটি আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যেটি খারাপ সেটিকে খারাপ বলার সময়েও দুটো লাইন জুড়ে দিয়ে কেন খারাপ সেটি উল্লেখ করে দেয়া বাঞ্ছনীয়।
একটা ভিডিও চোখে পড়ল সেদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদের নেতা সাবেক ডাকসু ভিপি নূর তার একটি রাজনৈতিক সমাবেশে মানুষকে আসার আহ্বান জানানোর সময়ে প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত অমূলক তথ্য দিয়ে একজন পথচারীকে বিভ্রান্ত করার সময়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে উল্টো নূরকে বলেন, তিনি বিশ্ব অর্থনীতির খবর রাখেন কিনা।

বিশ্ব বাজারেও যে প্রায় সবকিছুর দাম বাড়ছে সেই প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নূর বিব্রত হয়ে প্রায় পালিয়ে যান। তথ্যপ্রযুক্তির অনেক সমালোচনার মুখেও এটি একটি ভালো দিক। নাগরিকরা খুব সহজেই বিশ্ব বাজারের খবর জানতে পারছেন, তাদেরকে আগের মতো আর মিথ্যে তথ্য দিয়ে উস্কে দেওয়া যায় না। সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করলে এখন বিরোধী দলগুলোকে পড়ালেখা করে মানুষের কাছে যেতে হবে। না হলে দীর্ঘ দেড় যুগের প্রত্যাখ্যানের সময়কাল আরও বাড়বে।
১০ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি ঢাকায় গণসমাবেশের জন্য বহু পূর্ব থেকেই নির্ধারিত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা তাদের নয়াপল্টনের কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করতে চায় যার পিছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিএনপি জানে তাদের জনসমর্থন অত্যন্ত কম এবং নয়াপল্টনে সমাবেশ করলে সেখানে মানুষের ভিড় দেখানো সহজ হবে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে সমাবেশ করার মতো জনসমর্থন তাদের নেই।

দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বর মাসেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের হাতে পরাস্ত হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসরদের অনেকেই বাংলাদেশে থেকে গিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায়। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তাদের কাছে বিভীষিকাময় স্মৃতি। যে কারণে বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্রত্যক্ষ সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ করা সামরিক কর্মকর্তাদের খুন করা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত নানা স্থান-কাল-পাত্রকে ধ্বংস করার উৎসবে লেগে পড়ে।

এরই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে শিশুপার্ক বানিয়ে ফেলে পরবর্তী প্রজন্মের মন থেকে পাকিস্তানের পরাজয়ের স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি সমাবেশ করতে চাইবে না এটিই স্বাভাবিক। তৃতীয়, এটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে হয়। বিএনপি একটি উগ্রতাবাদী নাশকতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিñিদ্র। এখানে যেকোনো নাশকতা করা বিএনপির পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।

উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাছেই হওয়াতে সাধারণত ছাত্রছাত্রী এবং ছাত্রলীগের কড়া নজরের মধ্যে বিএনপির পক্ষে দেশের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোনো নাশকতা করা কঠিন হবে। ফলে তারা এখানে সমাবেশ করতে চাইছে না। সরকার খুবই দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে তারা বিএনপিকে নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে দেবে না। ঢাকার রাস্তাঘাটে এমনিতেও চলাচল করা যায় না সেখানে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে চেয়ে বিএনপির যে অভিলাষ তা কেবলমাত্র সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে সরকার ও জনগণকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

এটি দুর্ভাগ্যজনক এত বছর পর বাংলাদেশের মানুষ বার বার বিএনপিকে ক্ষমা করে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেও তারা সে সুযোগ না নিয়ে তাদের সকল কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত করেছে সন্ত্রাস ও সহিংসতা সংঘটিত করার উদ্দেশ্যে। তবে শেখ হাসিনার সরকার তাদের সে সুযোগ দিচ্ছে না, সাধারণ মানুষ হিসেবে এতটুকুও আমাদের স্বস্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক সাবেক শিক্ষকের গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার পর মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া এক নারীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে এক কিলোমিটার পথ।

রাস্তায় নারীর রক্ত ও শরীরের নাড়িভুঁড়ি লেপ্টে গেছে কিন্তু চালক থামেননি। নীলক্ষেতের কাছে তার গাড়ি আটক করে অভাগা ওই নারীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান। কী দুর্ভাগ্যজনক, মর্মান্তিক এই ঘটনা। কিছুদিন আগে আমার আব্বা, আম্মা, বোন ও ভাগিনার গাড়িতে করে বগুড়া যাওয়ার সময় আমি বলছিলাম গাড়ি চালাতে সাবধানে থাকার জন্য। কারণ চালক কতটা দক্ষ তার ওপর বাংলাদেশের সব দুর্ঘটনা নির্ভর করে না।

আপনি যত ভালো চালকই হন না কেন রাস্তার অন্যান্য বেপরোয়া ড্রাইভারদের অদক্ষতা ও কা-জ্ঞানহীনতা আপনাকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। এই যে একজন মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে তাকে সাহায্য করার জায়গায় চালক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এটি নীতি ও নৈতিকতা অবনমনের এক চরম দৃষ্টান্ত। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপগুলোর অন্যতম এ বিষয়ে নিশ্চিত। পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি কিন্তু আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া এমন অব্যবস্থাপনা আর কোথাও দেখিনি।

আফ্রিকার দেশগুলোতে তাও এটি অতটা প্রভাব ফেলে না। কারণ সেখানে মানুষ আর যানবাহন উভয়ই অনেক কম। কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে ইচ্ছামতো টাকা দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া যায়, পুলিশের পকেটে ১০০০ টাকা দিলেই যেকোনো অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, বেশিরভাগ গাড়ির ফিটনেস নেই, বাস ট্রাকের ড্রাইভাররা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান, সঙ্গে সঙ্গে এখন ধনী ও ধনীর সন্তানরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে রাস্তায় গাড়ি চালানোর যে প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করেছে তাতে করে মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা থাকছে না। তবে এ ক্ষেত্রে বিনয়ের সঙ্গে আরেকটা কথা বলতে চাই।

সাধারণ মানুষ হিসেবে এখানে আমাদের কিছু দায় আছে। আমরা যেভাবে ইচ্ছেমতো রাস্তা পার হই, চলমান গাড়ির সামনে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে দুলকি চালে রাস্তা পার হই, সেটা পৃথিবীর অন্য কোথাও বিরল। এছাড়া কোনো সামান্য দুর্ঘটনা হলেও যেভাবে আমরা আইন অমান্য করে যেকোনো গাড়ির চালককে পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করি তাতে করে দুর্ঘটনার মুহূর্তে কোনো চালকই গাড়ি থেকে নেমে দুর্ঘটনার শিকার মানুষের উপকার করতে চাইবেন না। নিজের জীবন বাঁচানো ফরজ মনে করে পালিয়ে যেতে চাইবেন।

দুর্ঘটনার পর গাড়ি ভাঙচুর ও চালক-হেলপারদের আটক না করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে যদি শাস্তির মুখোমুখি না করা যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুর্ঘটনা আরও ঘটবে। দুর্ঘটনার পর চালক পালিয়ে যেতে চেষ্টা করবে। আমরা যতদিন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের মতো উদ্যোগে স্কুলের শিশুদের দিয়ে গাড়ির লাইসেন্স চেক করানো যে একটা ভয়াবহ অন্যায় কাজ সেটা না বুঝব, ততদিন বেআইনি এসব ঘটনার চক্রেই পড়ে থাকতে হবে আমাদের। আসলে সব পক্ষের বোধোদয় না হলে পুরো সমাজকে পাল্টে দেওয়া কঠিন।
বেশ কিছুদিন পর বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের পর্দা নামল। সেরা ১৬ রাউন্ডে ইতোমধ্যে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে শক্তিশালী নেদারল্যান্ডস এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় দল আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশীরাও এই উন্মাদনার সাক্ষী। কাতার দেশ থেকে কাছে হওয়ায় হাজার হাজার বাংলাদেশী বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে এবার মাঠে গিয়েছেন। কানাডায় বাংলাদেশীরাও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলকে সমর্থন করছে তাদের দল কানাডা বিদায় নেওয়ার পর থেকে।

এই বিশ্বকাপের পর সর্বকালের সেরা ফুটবলার মেসিকে এই আসরে আর দেখা যাবে না। তাই শূন্যের নিচের তাপমাত্রায় বসে বিশ্বকাপের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে বাংলাদেশী কানাডিয়ানরাও। বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে তারাও প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কবে প্রিয় দলের হাতে উঠবে বিশ্বকাপ। এভাবেই চলে যাচ্ছে একেকটি সপ্তাহ।

টরন্টো
৪ ডিসেম্বর ২০২২

×