ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুখতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫০, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

রুখতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের

বিজয়ের মাস প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির জন্য অত্যন্ত আবেগের, মর্যাদার, সর্বোপরি অনুপ্রেরণা ও আত্মপ্রত্যয়ের

বিজয়ের মাস প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির জন্য অত্যন্ত আবেগের, মর্যাদার, সর্বোপরি অনুপ্রেরণা ও আত্মপ্রত্যয়ের। দেশপ্রেমিক এ কারণেই বলা হলো বাংলাদেশে যারা বসবাস করছেন সকলকেই দেশপ্রেমিক বলার সুযোগ নেই। একটি পক্ষ তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সঙ্গত কারণেই তারা ষড়যন্ত্রকারী ও দেশদ্রোহী। তাছাড়াও এখনো বাংলাদেশে এমন অনেকেই রয়েছে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার পাঁয়তারা করে থাকে।

ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। দেশের পরিচ্ছন্ন ইমেজকে নষ্ট করে দেশবিরোধী বিভিন্ন ধরনের কর্মকা- সম্পাদন করে থাকে। মানি লন্ডারিংয়ের পাশাপাশি তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, পণ্য মজুদ করে, জনবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করে, জঙ্গিবাদে অর্থ সহায়তা প্রদান করে থাকে, অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, গুজব সৃষ্টি ও গুজব রটায়, ধর্মভিত্তিক প্রপাগা-া ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে।
বিজয়ের মাস মূলত আমাদের নতুন করে অনুধাবনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বিশেষ করে যে কাক্সিক্ষত স্বপ্নে দেশপ্রেমিক মানুষগুলো সর্বস্ব ত্যাগ করে বাঙালির স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল, যারা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ ও নতুন পতাকা দিয়েছে, তাদের স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হয়েছে? কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণের জন্য ভবিষ্যতে কি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখানোর প্রয়োজনবোধ করে না অনেকেই।

কেউ কেউ আবার এ দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনকেও অস্বীকার করে থাকে। আপনি যে মতের, যে দলের বা যে পথেরই হোন না কেন, এ দেশে স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল না কিংবা পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল- এ বিষয়টি অনুধাবন করা হলে আপনার বাংলাদেশে থাকার অধিকার থাকে না। নতুন প্রজন্মকে যখন আপনি এ ধরনের আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য কথা বলবেন, তখন তারা কি আপনার এ ধরনের অর্বাচীনের প্রলাপ শুনে বিশ্বাস করবে?
পৃথিবী এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। ডিজিটালাইজেশন ও বিশ্বায়নের যুগে সকল কিছুই এখন মানুষের আয়ত্তে চলে এসেছে অর্থাৎ গোপন করার আর কিছু নেই। সেজন্যই বৃহদাকারে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই। তবু প্রজন্মের একটি অংশের তাদের কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হলে ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে ক্রমান্বয়ে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপাখ্যান, আন্দোলন-সংগ্রাম, মহান মুক্তিসংগ্রামে বীর সেনানীদের ভূমিকা, দেশদ্রোহীদের ভূমিকা ও তাদের পরিচয় ইত্যাদি সম্বন্ধে দেশ-বিদেশে বিখ্যাতজনদের গ্রন্থ রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত রয়েছে দালিলিক প্রমাণ। এ সকল কিছুর সহায়তায় বিশ্লেষণ করলেই দেশদ্রোহীদের পরিচয় সম্বন্ধে অবগত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তথাপি ইতিহাস খুঁজে, তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে, সঠিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের ভূমিকা কতটুকু সে বিষয়েও জেনে-বুঝে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনে কাজ করে যেতে হবে।
সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিজয়ের মাসে নতুনভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। প্রজন্মকে দেশের স্বাধীনতার পটভূমি ও প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে। প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, আওয়ামী লীগ নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনায় নেতাদের ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে প্রজন্মকে অধ্যয়ন করতে হবে।

সে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির চিত্র-প্রতিচিত্রকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টি, কালচার ও সংস্কৃতিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পরিবেশনার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই একটি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন চলে আসবে প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়। পরাধীনতার সকল শৃঙ্খল ভেঙে একাগ্রচিত্তে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে বিদেশীদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেছে বাঙালিরা। বাঙালিরা ১৯৪৭ সালে একবার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে সকল ধরনের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছে।

ভারতের এক বিখ্যাত সাংবাদিক বলেছেন, ‘আমরা ভারতীয়রা ইংরেজদের সঙ্গে আপোস করে তাদের দেওয়া ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। আমাদের কোনো বিজয় দিবস নেই। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাদের সব ধর্ম ও গোত্রের মানুষের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধের দ্বারা। তাদের একটি বিজয় দিবস আছে। তারা গর্বের সঙ্গে দাবি করতে পারে তারা বিজয়ী জাতি এবং একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। আমরা এই দাবি করতে পারি না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহাত্ম্য বিদেশী বন্ধুরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সম্মান জানায় এবং তাদের দেশে এ বিষয়গুলোকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি পক্ষ মনে করে যুদ্ধের ইতিহাস বারবার টানার কি প্রয়োজন রয়েছে? মূলত এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন করে তারা স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায়। ধামাচাপা দিতে চায় সত্যকে। ইতিহাসকে কখনো বিকৃত করা যায় না। আমরা একটা সময় দেখেছি ইতিহাসের বিকৃতি তথা যোগ্যদের মূল্যায়নে কৃপণতা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়েছে। এ ধরনের বিষোদগার ও হেয় মানসিকতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকেই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সেখানে কাউকে বড় করে অন্যকে ছোট করার অবকাশ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ।

সেখানে প্রত্যেকের অবদানকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্বীকার করা উচিত। না হলে দেশের বীর সন্তানদের অবমূল্যায়ন করা হবে। তাদের প্রতি করা হবে অবিচার। এহেন বিমাতাসুলভ আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের সঠিক পাঠ নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে।

হুমকি-ধমকি, বিদেশী চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর কম কথা নয়। আওয়ামী লীগ সরকার সে সাহসটুকু দেখিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল করেছে। তথাপি এখনো স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পরিপূর্ণ দলিলের অপেক্ষায় রয়েছে স্বাধীনতাপ্রেমী জাতি।
বিজয়ের পরম আকাক্সিক্ষত মাসে সবথেকে বেদনার বিয়ষটি হচ্ছে ১৪ ডিসেম্বর রাতে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়। এদেশীয় দোসররা যখন বুঝতে পেরেছে পাকিস্তানীদের পরাজয় অত্যাসন্ন ঠিক তখনই তারা এ দেশের বীর সন্তানদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

তারা চেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ যেন কখনো ঘুরে দাঁড়াতে না পারে। সে কারণেই তারা হত্যা করে বুদ্ধিজীবীদের। অথচ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতি নিয়ে পাকিস্তানের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীরা পত্রিকার পাতায় কলাম লিখছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাদের লেখায়।

সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বীকার করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংস হত্যাকা- ও অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছিল সে বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ওয়াকিবহাল ছিল না। তবে বর্তমানে তারা তৎকালীন অত্যাচার ও অবিচার সম্পর্কে জানতে পেরেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও দলিল নথিতে। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের যে প্রকৃত দর্শন ছিল সে সম্বন্ধেও তিনি চমৎকার মূল্যায়ন করে বাংলাদেশের জাতির জনককে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিজয়ের মাসে বিএনপি ও তাদের সহযোগীদের ১০ ডিসেম্বর সভা আহ্বানকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি প্রদান করেছে। অথচ বিএনপি যে কোনো মূল্যে নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে মর্মে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের একটি আভাস দেখা যাচ্ছে।

আবার দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে কতিপয় রাজনীতিকে কূটনীতিকপাড়ায় দৌড়াদৌড়ি বিজয়ের মাসের মাহাত্ম্যকে অনেকাংশে খাটো করার শামিল। দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা না করে কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হওয়া স্বাধীনতার দর্শনকেই খাটো করে। কতিপয় রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এ বিষয়ে বোধোদয় যত শীঘ্র হবে, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি তত দ্রুত হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় নেতৃবর্গ স্বীকার করে নিলেও এদেশীয় দোসররা এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি দিয়ে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে অচল করে দিতে চায়। এ ধরনের ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে প্রচলিত আইনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। যারা দেশের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগ করে বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে চায় তাদের চিহ্নিত করা আবশ্যক। কেননা, সংকট মোকাবিলায় শত্রুদের চিহ্নিত করে দেশপ্রেমিক জনগণকে একত্রিত হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করা উচিত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×