ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মার্চ থেকে ডিসেম্বর ॥ আনন্দ-বিষাদের যাত্রা

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৫০, ১ ডিসেম্বর ২০২২

মার্চ থেকে ডিসেম্বর ॥ আনন্দ-বিষাদের যাত্রা

১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চের চট্টগ্রাম

১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চের চট্টগ্রাম। পুরো জীবনে জ্বল জ্বল করতে থাকা মহান কতগুলো দিনের মধ্যে অবিস্মরণীয় দুটো দিন। শিশু জন্মদানের জন্য তরুণী আমি মা-বাবার কাছে ঢাকা থেকে এসেছি। এক বছরের মধ্যে দুই শিশুর জন্মদানে এম এ পাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, মা ছিল প্রচ- ক্ষুব্ধ। আমিও ছিলাম নির্বোধের মতো কাজ করার জন্য নিজের ওপর অসন্তুষ্ট। মাকে এড়িয়ে বাবার সঙ্গে, ভাইদের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করা মতিয়া আপা, মেনন ভাইদের অনুসরণকারী মেয়েটি দেশের রাজনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ঝড়ো আলাপ-আলোচনায়রত। একটি কাক্সিক্ষত যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ এগিয়ে আসছে।

অথচ এ কাক্সিক্ষত স্বপ্নের যুদ্ধে একটি বোকামির ফলে এ যুদ্ধে যোগ দিতে পারব না ভেবে মন হয়ে উঠত বিষণ্ণ। শিশুদের দিকে মনোযোগ দিতাম না। বরং আমাকে হাত-পা বেঁধে পঙ্গু করে ফেলার জন্য বিরক্ত হতাম। যেটুকু না করলে নয়, সেটুকুই করতাম। মার মুখে চোখে চরম বিরক্তি দেখে মায়ের কাছে ঘেষতাম না। এমন সময়ে ২৫ মার্চ, ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো! কেন? বাবা, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষকের বাড়িতে টেলিফোন, বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগাতে পারেনি। তাই ফোনে খবর নেওয়া হলো না। পাড়া-প্রতিবেশী যাদের আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় থাকে, ঘরে ফোন আছে, তাদের কাছ থেকে ঢাকার খবর জানার চেষ্টা করছে। এক ছেলে ঢাকা থেকে হেঁটে-রিকশায়-ট্রাকে চেপে চট্টগ্রাম ফিরেছে। তাকে ডাকা হলো। তার কথা হলোÑ ‘চাচার কোনো বাড়ি-ঘর আর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু মানুষ গোলাগুলিতে মারা গেছে।’ সবাই কিছুটা চিন্তান্বিত হলো। কিন্তু ওর কথা স্পষ্ট করে না কোনোকিছু। বাবা বিরক্ত হয়ে ওকে বিদায় দিল। সারাদিন একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় কাটাল পুরো চট্টগ্রামবাসী। ২৬ মার্চ খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল একদল মানুষের ঘুম-ভাঙ্গা গলায় স্লোগানের আওয়াজে। মুহূর্তে ছুটে পেছনের ঘর থেকে রাজপথ সংলগ্ন সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভোরে ওঠা বাবা আগেই দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে বললÑ ‘জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিকরা।’ ভাঙ্গা গলায় কুয়াশায় মোড়া সাদামাটা শ্রমিক মানুষের মূর্তিগুলো খালি গলায় বলে চলেছেÑ ‘ঢাকায় শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ....’। উঃ! এর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করেছি! আজ যদিই বা কাক্সিক্ষত, মহান যুদ্ধ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি কেন তাকে বরণ করে নিতে অক্ষম! হায়! হাত-পা বাঁধা এ আমি ‘ও’র কোনো কাজেই তো আসব না! স্লোগান দেয়া দরিদ্র হ্যাংলা, পাতলা শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভিজে উঠল মনটা। বাবা বলল, ‘যা ভেতরে, এ ঠা-া বাতাসে তোর দুর্বল শরীরে ঠা-া লেগে যাবে।’ অনেক্ষণ ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি একটা অবরুদ্ধ কান্না বুক থেকে গলায় এসে আটকে থাকল।
এরপর চট্টগ্রামজুড়ে বিজয়ের মতো আনন্দ, খুশি, উচ্ছ্বাস রাস্তায়, পাড়ায় মানুষের কোলাকুলি, এক গাল হাসি, পান খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, গাল গল্প চলতে লাগল। স্বাধীনতা আর দূরে নয়। পাড়ার ছোট ছেলেদের নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ছোট ভাই মোমেনের বন্ধু আলতাফ, পরে কবি, রাস্তায় কয়েকবার ঘুরে গেল। মনসুরের বন্ধু সাইফুদ্দীন এখন খুব ব্যস্ত হবে। ওর বাবা তো শ্রমিক নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। মিষ্টি চেহারার সাইফুদ্দীন একদিন পাকি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে মারা যাবে, এতো সেদিন স্বপ্নেও ভাবিনি! সারাদিন মামারা, অন্য পাড়ার লোকজন আসা-যাওয়া করছে। মামারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতির খবর দিচ্ছে। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগের ছাত্র নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণ অস্ত্র জমা করার খবর দিচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। ভয়ের চিহ্ন মাত্র কারও মধ্যে নেই। মহানন্দে রাত কাটাল চট্টগ্রামবাসী। তবে রাজনীতিবিদদের মধ্যে নিশ্চয় ছিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ২৭ মার্চ সকাল। সবাই আরেকটি ঈদের দিন কাটাচ্ছে। আমি তো রাজপথের পথিকÑ যান চলাচল দেখার চিরকালের দর্শক। সেই ছোটবেলা থেকে অর্ধেক হওয়া বাড়ির সামনের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে নেইÑ এ ছিল অকল্পনীয়। অনেক সময় আমার সাথী থাকত মনসুর, মোমেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়লÑ পাড়ার তরুণ-কিশোররা চাঁদা তুলছে! দেখলাম, আমাদের দুই তিনজন বাঙালি সেনাসদস্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে কোনোক্রমে শহরে এসেছে। তারা আর্মির পোশাক ছেড়ে লুঙ্গি-জামা পরা। তাদের খাওয়াতে হবে, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যান্টনমেন্টে পাঞ্জাবি সেনারা বাঙালি সেনাদের হত্যা করছে! একদল চাঁদা তুলছে। অন্য অনেক তরুণ ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা হয়েছে। ওরা বাঙালি সেনাদের রক্ষা করতে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবে। দলে দলে তরুণ ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে যাত্রা করছে। পালিয়ে আসা বাঙালি সেনাদের কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টে থাকা অস্ত্র কেড়ে নেওয়া বাঙালি সেনাদের শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে মন খুব খারাপ হয়ে গেল সবার। আমি দৌড়ে ভেতরে গিয়ে আমার হাতব্যাগ খুঁজে একটা দশ টাকার নোট পেলাম। সেটি ছেলেদের ডেকে তাদেরকে ছুড়ে দিলাম। ওরা নোটটি গামছায় তোলা টাকার সঙ্গে রাখল। বাবাকে বললাম, ‘ওদের চাঁদা দাও, ওরাই তো যুদ্ধ করবে’। বাবা ৫০ টাকা ছেলেদের ডেকে চাঁদা দিল। তবে আমরা জানি আমাদের কাজীর দেউড়ী পাড়ার জমিদার চাচা যত লোকই আসুক না কেন, সবার খাবার ব্যবস্থা, কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা করবেন। দৌড়ে দৌড়ে একবার ভেতরে যাই, আবার বারান্দায় আসি, আরও কত বাঙালি সেনা পালাতে পেরেছে দেখতে। পরে যারা আসছে তাদেরকে জমিদার চাচার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে বৈঠকখানা, দুই তিনটা অতিরিক্ত ঘর, দুটো পুকুর, বেশ বড় ফলবাগান, মসজিদ, কবরস্থান নিয়ে জমিদার বাড়ি। কেউ সে বাড়ি থেকে না খেয়ে আসে না। আমাদের পাড়ায় এমন একজন অভিভাবক থাকায় আমরাও নিশ্চিন্ত ছিলাম। বিকেলে মনসুর, মোমেন ট্রানজিস্টার-এ কোনো বিদেশী চ্যানেলে কোনো খবর পাওয়া যায় কি-না শুনতে চেষ্টা করছিল। আমিও কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করছি। একটু পরেই নব ঘোরাতে ঘোরাতে ওরা হঠাৎ চট্টগ্রাম বেতার পেল। আশ্চর্য, সে সময়ই মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী পাঠ করছিল! এরপর এই একই ঘোষণার পাঠ বার বার সম্প্রচার করা হচ্ছিল। একটু পরে হঠাৎ ওরা চেঁচিয়ে উঠল, অতি ক্ষীণ আওয়াজে একটা চ্যানেলের খবরে শোনা গেলÑ‘পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে .....।’ অতি ক্ষীণ সেই আওয়াজে ওদের মনে হয়েছিলÑ সেটা রেডিও ইরান-এর সম্প্রচার। জানি না ক্যান্টনমেন্টে কত বাঙালি সেনা ভাই তখন নিহত হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বেতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। সত্যিই এবার আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে নামব। রাতে ভাত খেয়ে এক নতুন, অন্যরকম দিন আসবে ভেবে আমরা চট্টগ্রামবাসী ঘুমাতে গেলাম ২৭ মার্চ রাতে। ঘুমিয়ে ছিলাম দুই শিশু, ওদের বাবাসহ। তিনি আমাদের ঢাকায় নিয়ে যেতে এসে হঠাৎ যোগাযোগÑ রেল, বাস, বিমান সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আটকে গেছেন। মধ্যরাতে হঠাৎ আকাশ দীর্ণ করে হাজার হাজার আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে বুম বুম ভারি শব্দ চারদিক থেকে আমাদের ভীতিকর এক অন্ধকারে রাজ্যে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে উঠলাম। মার ঘরে মা উঠে বসে আছে। বাবা উঠেছে, ভাইরাও ঘুম ভেঙ্গে উঠেছে। মা সংক্ষেপে বললÑ ‘ওরা কামানের গোলা ছুড়ছে’। মা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখেছে। এ মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনারা চট্টগ্রামে ক্যাম্প করেছিল। জাপানি যুদ্ধ বিমান চট্টগ্রামে বোমা ফেলেছে বেশ কয়েকবার। ওই যুদ্ধের মধ্যে বাবা চট্টগ্রাম কলেজে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বদলি হয়ে রেলে সপরিবার ওঠার চেষ্টায় এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন। ব্রিটিশ সেনারা সব বগি দখল করে রেখেছে। আট বছরের বড়দা, চার বছরের ছোড়দা, মার কোলে আট মাসের মামুন। সুশ্রী ছোড়দার গগনবিদারী কান্নায় কোনো কোনো ইংরেজ সৈন্য ওর হাতে পনির, কমলা গুঁজে দিচ্ছে। অবশেষে তাদের দয়ায় স্টেশন মাস্টার মা-বাবাকে রেলের একটা কামরায় জায়গা দিতে পেরেছিল। সেসব গল্প বিশেষ  করে জাপানি বোমা, প্লেনে প্লেনে ডগফাইট, বৈমানিকের মৃতদেহের অংশ গাছে ঝুলে থাকার কাহিনী শুনে বহু দূরের অতীতের ভুলে যাওয়া যুদ্ধকে হঠাৎ আমাদের মাথার ওপর এসে পড়তে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ প্রতিদিন এ যুদ্ধকেই তো চাচ্ছিলাম! মা বললÑ ‘সব জানালা বন্ধ কর, দরজাও খুলবে না’। এদিকে শেষ রাতে ওই গোলাগুলির মধ্যেই বাড়ির পেছনের ছোট দরজার কাছে লণ্ঠন হাতে দুই তিনজন লোক নিয়ে জমিদার চাচা ডাক দিলেনÑ ‘বদ্দা, বদ্দা, (বড়দা), তাড়াতাড়ি আপনারা সবাই এই পেছনের দরজা দিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসুন। ওরা তো আপনাকে চেনে। এই বড় রাস্তার ওপরের বাড়িতে থাকতে পারবেন না’। বাবা তাড়াতাড়ি পেছনের বারান্দায় এসে উত্তরে বললÑ ‘তুমি এখন বের হলে কেন? আমরা কাল দিনের বেলা সব গুছিয়ে বিকালে যাব, এখুনি যাওয়া যাবে না। এখন তুমি বাড়ি ফিরে যাও।’ চাচা বললেনÑ ‘কিন্তু দেরি করবেন না, চলে আসবেন।’ আজ ভাবিÑ ওই একটি ছোট পেছনের দরজা আমাদের কি সাহায্যই না করেছিল। পরদিন আমাদের চাচার বাড়ি যাওয়া হয়নি। আমার স্বামীর তীব্র পেট ব্যথা শুরু হলো, সঙ্গে বমি। এই অবস্থায় অসুস্থতা ভীষণ সমস্যার বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসায় সঙ্গে থাকা ভাই মানিককে রেখে এসেছিল। দেশের বাড়ির মা, বাবা, ভাইবোনদের অবস্থাও জানা যাচ্ছিল না। ছোড়দা ছিল ঢাকায় তার খবর আমরা জানি না। যা হোক, যে কোনো বিপদে বাবা ধৈর্য হারাতেন না। বাবা ওকে মোমেনের সঙ্গে ডাক্তার সৈয়দুল হকের কাছে পাঠাল চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার সাহেব বললেনÑ ‘মনে হচ্ছে কিডনিতে পাথর হয়েছে। ওষুধ দিচ্ছি, এখন ব্যথা কমাতে হবে। ওষুধে ব্যথা কমতে শুরু করল। এদিকে মা চাল-ডাল-আলু, সরিষার তেল, চুলার কেরোসিন তেল, এসব কিনে আনতে কাজের ছেলেটাকে পাঠাল। ২৮ মার্চ দিনে এসব হচ্ছে। দোকানদাররা পেছনের দরজা খুলে ক্রেতাদের চাল, ডাল, আটা, তেল, আলুÑ এসব বিক্রি করছে। তারা এখন যে যার দেশের বাড়ি চলে যাবে। একবার চট্টগ্রাম বেতারে ঘোষণা হলোÑ যুবকেরা যেন লালদীঘি ময়দানে অস্ত্র প্রশিক্ষণে যোগ দেয়। একটু পরেই নতুন ঘোষণায় যুবকদের জমায়েত হতে নিষেধ করা হলো। শুনেছি, পাকি হানাদার বাহিনী এ জমায়েতের ওপর বোমা হামলা করে বিপুলসংখ্যক যুবকের মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে এটি বন্ধ করা হয়। মা সব খাদ্যসামগ্রী বস্তায়, পুঁটলিতে গোছাচ্ছে।
এল সেই ভয়ঙ্কর শেষ বিকেল। জানালার ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে দেখতে গেলাম, হঠাৎ চারদিকে গোলাগুলি। আর তার সঙ্গে ছন্দবদ্ধ বুটজুতার ভারি কিন্তু নিয়মবদ্ধ আওয়াজ। কেন? রক্ত হিম করা যে দৃশ্য দেখলাম, সে ছিল অবিশ্বাস্য। ওই দূর পশ্চিমে দিকের পাহাড় আর ক্লাবের মাঝখানের শূন্য রাস্তা দিয়ে সারিবদ্ধ সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা দল গুলি করতে করতে দক্ষিণ দিকের সার্কিট হাউসে প্রবেশ করছে। সারিবদ্ধ বুটজুতার আওয়াজ জানান দিচ্ছিল সামনের ভয়ঙ্কর দিনের। অনেক পরে জেনেছিÑ ২৭ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সেনা নিয়ে আসা সোয়াত জাহাজের অস্ত্র নামাতে বাঙালি শ্রমিকরা অস্বীকার করে ওখানে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান করছিল। তাদের ওপর পাঞ্জাবি সেনারা মাঝে মধ্যেই গোলাগুলি করছিল, নিহত-আহত হচ্ছিল দেশপ্রেমিক অসংখ্য বাঙালি শ্রমিক। শেষে ওদের বাধা সরিয়ে পাকিস্তানি সেনাদল সেদিন শহরে প্রবেশ করেছিল। জানা গেল, ওরা প্রবেশ করেই একদল বেরিয়ে আসে এবং আশপাশের তরুণ-কিশোরদের দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করিয়ে কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে যায়। এবার ওরা শহরের পাড়ায় নামবেÑ এ কথা ভেবে নারী-পুরুষ, তরুণ-কিশোর-শিশুদের নিয়ে রাজপথ এড়িয়ে পাড়ার ভেতরের পায়ে চলার পথে নেমে এলো। কোথায় যাবে, সেটি কারও জানা নেই। তবে বাড়িতে থাকা যাবে না- এটি যেন সবাই জেনে গেছে।
ওদিকে জমিদার চাচাকে কারা বলেছে, বাঙালি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। তিনি তখনই পুকুরে জাল ফেলতে নির্দেশ দিলেন। হায়! একটু পরেই জানা গেল ওরা শত্রুদল। সোয়াত জাহাজ থেকে শহরে নেমেছে! সেদিন বের হওয়া সম্ভব ছিল না। মধ্যরাতে আমাদের বাসার সামনের খালি মাঠ দিয়ে দামপাড়া পুলিশ ক্যাম্প থেকে পুলিশ ভাইয়েরা উত্তরের নেভি অফিসে অবস্থারত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচ- গোলাগুলির মধ্যদিয়ে চট্টগ্রামে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের অসম লড়াই শুরু করে। জানতে পারিনি, সে রাতে ২৮ মার্চ, আমাদের কতজন বাঙালি পুলিশ প্রাণ দিয়েছিল। সে রাতে এ পাড়ার কেউ ঘুমায়নি। খুব ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় নেমেছে। এর মধ্যে জানালার ছিদ্র দিয়ে দেখলাম, দ্রুত বেগে এক জিপে আমাদের ক’জন বাঙালি যুবক কিছু রাইফেল নিয়ে হয়তো কোনো দলে যোগ দিতে যাচ্ছিল। নির্বাক চেয়ে চেয়ে দেখলাম পাকিস্তানি সৈন্য দুজন ভেতরে রাইফেলের গুলি করল। বুকটা ব্যথায় দীর্ণ হলো। কেন তোরা নেভি অফিস, সার্কিট হাউসের কাছের এ রাস্তাটা ধরলি। মা বলল, ‘আর দেখে কি হবে, বাচ্চাদের কাঁথা-কাপড়, দুধ-চিনি, তোমাদের দুটো কাপড় গুছিয়ে নাও’। গুছাচ্ছি একটা স্যুটকেসে। বাবা বন্ধ ঘরের ভেতর পায়চারী করছেন। এমন সময় কাঠের দরজা ভেদ করে প্রচ- শব্দে একটা গুলি বাবার কোমর ঘেঁষে মেঝেতে পরল। নেভি অফিসের দিক থেকে এসেছে। এ গুলি যেন বার্তা দিল এবার ওরা পাড়ায় নামবে! এবার জমিদার চাচার বাড়ি যেতে হবে। বিকাল হতেই শুরু হলো ম্যাজিস্ট্রেট পাহাড় থেকে সার্কিট হাউস লক্ষ্য করে মর্টারের গোলা ছোড়া। দুই দিক থেকে প্রচ- গোলাগুলি শুরু হলো। বাড়ির পেছনে খড়ের বাঁশের চালা ঘরে গোলা পড়ে আগুন ধরে গেল। পাহাড়ি বয়সী সুন্দর বালকটি আহত হলো। শুধুমাত্র চিকিৎসার অভাবে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে রাতে মারা গেল বালকটি। ভীষণ আতঙ্কিত হলাম। পরদিন চাচার খালি থাকা একটা বাড়িতে আমাদের জায়গা হলো। মা কেরোসিন চুলায় রান্না করত। আমি বাচ্চাদের দেখা, খাওয়ানো, কাপড়, কাঁথা ধুই। সার্কিট হাউস,  নেভি অফিস থেকে প্রায় সারাদিন গোলাগুলি ছোড়া হত। আমাদের ইপিআর, পুলিশ বাহিনী যুদ্ধে নিরীহ মানুষের মৃত্যু হতে দেখে দূরে সরে গেছে। হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি চলছেই। এর মধ্যে একদিন মীরু খালা, মামা, মামি, খালাতো ভাই-বোন জনমানুষের ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকা সারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজী চাচার বাড়িতে এলো। এসেই মাকে বললÑ ‘এই মেয়েকে তুমি রক্ষা করতে পারবে না। আমরা এখন চান্দগাঁও যাব, তারপর কোনো একদিকে যাব, কিন্তু, মেয়েকে বাঁচাতে হলে এখুনই আমাদের সঙ্গে দাও।’ মঈন মামাও একই কথা বলল। বাবা-মা রাজি হলো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে ক’খানা কাঁথা কাপড়, দুধের টিন, চিনি নিলাম। আমার স্বামী প্রায় ফাঁকা স্যুটকেসটি ঘাড়ে তুলে নিল। খালাতো বোন রুবী আঠারো মাসের বড় মেয়েকে কোলে নিল। দুই-তিন মাসের ছোট মেয়েকে কাঁথায় জড়িয়ে খালা নাজমা কোলে নিল। আমি সব মামা-খালাদের প্রিয়। সবাই ওই বিপদেও আমাকে সাদরে টেনে নিল। মা আমাকে একটা বড়, ভারি চাদর দিয়ে মাথা থেকে সারা গা ঢেকে দিল। সুরা পড়ল। তারপর বিদায় দিল।
ওইদিন আমি দুই শিশু নিয়ে গন্তব্যহীন অজানার পথে লক্ষ্যহীন উদ্বাস্তুর সঙ্গে লম্বা এক অন্তহীন জনস্রোতে মিশে গেলাম। দেখলাম, আমি যেমন চিন্তাহীন, তেমনি অন্য সবাইও চিন্তাহীন। কোথায় গন্তব্য, তা না জেনেও পাকিস্তানি সৈন্যদের থেকে দূরে যেতে পেরে সবার মধ্যে ছিল এক অদৃষ্টপূর্ব স্বস্তিবোধ। সবাই যেন জানে, কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো বাঙালির কাছে একমুঠো খাবার, একটা আশ্রয় মিলবেই! সেদিন আমরা সত্যিকার উদ্বাস্তু হলাম।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×