
.
বাঙালি জাতির এক প্রতিচ্ছবি বাঙালির বাঙালিয়ানা। এই বাঙালিয়ানা সংযুক্ত করেছে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এমনকি চিন্তা-চেতনার জগৎকে। ধর্ম-বর্ণ-জাত কোনোকিছুই এই বাঙালিয়ানার ঊর্ধ্বে নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতির সকলকে নিয়েই গড়ে উঠেছে এই বাঙালিয়ানা। বাঙালিয়ানা বাঙালি জাতির জীবনযাপনের এক সংক্ষিপ্ত রূপ। বাঙালি জাতির জীবনের ছোট ছোট প্রতিটি কোণ ঘেঁষে তৈরি এই বাঙালিয়ানা। এই বাঙালিয়ানায় যেমন বিরাজ করছে বাঙালির প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তের আচরণ, তেমনি বাঙালির আগলে ধরে রাখা নানা সংস্কৃতি। বাঙালি জাতির একদিন কিংবা এক যুগের কোনো ধারণা নয়, বরং শত শত বছর পার হয়ে সৃষ্টি এই বাঙালিয়ানার। শত বছর পার করে সমৃদ্ধ হতে হতে আজকের এই রূপ।
বাঙালি জাতির পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার, সাংস্কৃতিক চর্চা, দৈনন্দিন জীবনযাপন সবকিছুর এক সমন্বিত রূপ এই বাঙালিয়ানা। কেউ একা এই বাঙালিয়ানার ধারক নয়, বরং পুরো সম্প্রদায় এই চর্চার চক্রে বাঁধা পড়ে আছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বাংলাদেশে জন্মিয়াছে বলিয়াই যে সে বাঙালি তা নয়, বরং সে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়া চিত্তলোকে যাতায়াত করিতেছে বলিয়াই তাহারা বাঙালি। আমাদের বাঙালিদের গোড়াতেই বেঁধে আছে এই বাঙালিয়ানা।
বাঙালির এই বাঙালিয়ানায় কখনো মরিচা না পড়ুক এটাই প্রতিটি বাঙালির কাম্য। কিন্তু সময় ও কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ধারণা কিভাবে যেন আঁকড়ে ধরে ফেলেছে বাঙালিদের এই বাঙালিয়ানাকে। অনেক সময় বাঙালিরা ভুলে যাচ্ছে তার নিজ শিকড়কে। আবার অনেক সময় নিজেদের হারিয়ে ফেলছে আশ্রয় করা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, যা তার নিজের নয়, কখনো ছিল না। প্রতিটি জাতির নিজস্বতা তার এক গর্বের বিষয়। কিন্তু এই ধারণাটি অনেক সময়ই তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে বাঙালিয়ানার এই ধারণাটিকে রূপ দিয়েছে বিলাসিতার এক প্রতীকে। আবার অনেকে যেন এটিকে বানিয়েছে উৎসবের আমেজ। কিন্তু আসল বাঙালিয়ানা রক্ষার গরজ নেই কারও মাঝেই।
পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, কিংবা বসন্তবরণ সবকিছুই বাঙালি সংস্কৃতির এক একটি অংশ। আর এ সংস্কৃতিগুলো পালনে বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় এক অন্যরকম প্রাণবন্ততা। কিন্তু এই উৎসবগুলো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সংস্কৃতি রক্ষার ঝোঁকও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। সকলে আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠেন আধুনিক জীবনযাপনে। আগামী উৎসবের জন্য আবার তুলে রাখেন নিজেদের আসল বাঙালিয়ানাকে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সংমিশ্রিত সংস্কৃতিতে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব রয়েছে। বাঙালিয়ানা শব্দটি একত্রিত করেছে বাংলার এই মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়কে। যার যার ধর্ম আলাদা হলেও সকলের মাঝে বিরাজমান একটি সংস্কৃতি। বাঙালি জাতির রয়েছে নিজস্বতা কিংবা স্বকীয়তা। আর এ সকল বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাঙালির বাঙালিয়ানা। একটি রাষ্ট্র কিংবা সমাজের কেন্দ্রে থাকে সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম। আর তরুণ প্রজন্মের মাঝে যদি থাকে নিজ সংস্কৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান ও ধারণা তাহলে সেই জাতির ভিত অনেকটাই শক্ত থাকে। আর বর্তমান প্রজন্মের মাঝে যদি বাঙালির বাঙালিয়ানার যথার্থ জ্ঞান ও এর প্রতি সম্মান থাকে তবে বাঙালি জাতিরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। বাঙালি জাতি যেন তাদের নিজ সংস্কৃতিবিমুখ না হয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়ে বাংলার এই সংস্কৃতির প্রতি দেখা যাচ্ছে নানারকম অবহেলা। ধার করে আনা সংস্কৃতি ও নিজ সংস্কৃতির মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। কিন্তু আমরা যদি নিজ সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে এক ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি তবে ক্ষুণ্ণ হবে এই বাঙালিয়ানা নামক ধারণাটি, যা আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার মূল হাতিয়ার। আর যদি আমরা নিজ সংস্কৃতিকেই রক্ষা করতে না পারি তবে হয়তো এক সময় আমরা নিজেরাই হারিয়ে যাব। বাঙালির বাঙালিয়ানা চর্চা কিংবা নিজ সংস্কৃতি চর্চা নিজ অস্তিত্ব রক্ষার এক অপরিহার্য বিষয়। আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করি।
আর এই স্বাধীন দেশে বসবাসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রয়োজন সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা জীবনধারণের স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা যেন নিজ সংস্কৃতির জন্য বাধা কিংবা নিজ সংস্কৃতিবিমুখ না হয়। সংস্কৃতি একটি জাতির আয়নাস্বরূপ। আর এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সমন্বয়ে। বাঙালিয়ানা বাঙালি জাতিরই প্রতিচ্ছবি। আর তাই আমাদের বাঙালিয়ানা রক্ষা করে চলা উচিত। বাঙালিয়ানা ধরে রাখতে তরুণ প্রজন্মকে হতে হবে সচেষ্ট। আর নিজ সংস্কৃতিকে ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলাতেই রয়েছে প্রকৃত সার্থকতা।
লেখক : সমাজকর্মী