ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

হেলায় হারায় হেঁয়ালি হিরণ

শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৫১, ৪ অক্টোবর ২০২২

হেলায় হারায় হেঁয়ালি হিরণ

হেলায় হারায় হেঁয়ালি হিরণ

টরন্টোর ডাউনটাউনে বছরজুড়ে নির্মাণ কাজ জারি থাকে। সুউচ্চ অট্টালিকা গড়ে উঠছে একের পর এক, রাস্তা ভাঙ্গা-গড়ার কাজ চলছে, পুরান দোকান উঠে গিয়ে চকচকে নতুন দোকান আসছে ব্যস্ত সড়কের দু’পাশে। শনি-রবি, ছুটির এই দুদিনেও ভাঙ্গা-গড়ার কাজ থেমে থাকে না। তবে এসব কাজের ব্যাপারে এলাকার মানুষজনকে বহু আগে থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, কখনও কখনও এমনকি বছর খানেক আগে থেকেই।

কানাডায় প্রথম এসে যখন এখানকার সিটি কর্পোরেশনের অফিস থেকে এমন নোটিস পেতাম, ভাবতাম, ঠিক আছে এ আর এমন কী! নিশ্চয়ই চার-পাঁচ মাসের কাজ। কিন্তু কীসের কী! বছরের পর বছর ধরে এদের কাজ চলতে থাকে, শীতের সময় শুধু গতিটা কিছুটা শ্লথ হয়। থাকতে থাকতে বুঝে গেলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে সভ্যতার এই নিত্য-নতুন অগ্রগতির হাত থেকে মুক্তি নেই। একটা ভবনের কাজ শেষ হলো তো পাঁচটা নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়। ছোট সুন্দর দোতলা বাড়িগুলো ছেড়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের মালিকরা। যাবার সময় বিক্রি করে দিচ্ছে উচ্চদামে।

সেই উচ্চদামে কেনা বাড়ি ভেঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ৭০-৮০ তলা নতুন ভবন। প্রতি বছর সাড়ে চার লাখের বেশি অভিবাসী আসছে কানাডায়, যার সত্তর শতাংশের আবাস হয় অন্টারিওতে। তাদের অনেকেই আবার সুবিধামতো জীবিকা ও উচ্চশিক্ষার জন্য থাকতে চায় টরন্টোর আশপাশে। ফলে এখানে জমির দাম বাড়ছেই। ঢাকাবাসীর কাছে এই গল্প নতুন কিছু মনে হবার কথা না। খানদানি ধনী পরিবারের বন্ধুদের কাছে শুনি একসময় কী ভীষণ নীরব ছিল সেই সময়ের গুলশান,বনানী,বারিধারা এলাকা। দু’একটা বড়লোক বড়লোক চেহারার রেস্তোরাঁর সামনে দামী দামী গাড়ি ছাড়া পুরো গুলশানে রিক্সা ছাড়া ঘুরে বেড়ানো যেত আরামসে।

আমার নিজের প্রথম গুলশান অভিজ্ঞতা যা খুব করে মনে পড়ে সেটি ২০০৩ সালের ঘটনা। সূর্য ডুবে যাবার পর একাকী রিক্সায় করে গুলশান ১ থেকে ২ যাচ্ছিলাম। ওটাই আমার প্রথম একা গুলশান এলাকায় ঘোরা। সবকিছু অন্ধকার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে তখন যেসব বাতি জ্বলত তা একটা ছমছমে আদিভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি করত। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা এত বেশি ছিল না যে হেডলাইটের আধিক্যে অন্ধকার রাস্তা আলোকিত হয়ে যাবে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ি। গুলশান এলাকাকে কখনও আমার নিজের মনে হতো না। বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে কুমিল্লা, খুলনা, যশোর হয়ে মিরপুরে আসা নব্বই দশকের শুরুর দিকে।

২০০৭ সালে স্থায়ীভাবে গুলশানে পাড়ি দেয়ার আগ পর্যন্ত মিরপুর, আজিমপুর, লালবাগ, ইস্কাটন গার্ডেন আর পরীবাগে অস্থায়ী নিবাস। বোধহয় বেড়ে ওঠার সময়টাতে বার বার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোয় শিকড় গাড়ার স্বভাবটা আর হয়ে ওঠেনি আমার। এখনও এর খুব বড় কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। এসব ভাবছিলাম শনিবার দুপুরে। সকালে ঘুম পুরো হয়নি। মিকির চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল সোয়া ৮টায়। তারপর ওকে আদর করে, জানালার পাশে বসিয়ে আর ঘুমুতে পারলাম না। সূর্যের নরম আলো গায়ে মেখে যখন ইউনিভার্সিটির জিমে ঢুকলাম তখন বাজে সকাল সাড়ে ৯টা।

দরজার মুখে ল্যাপটপ খুলে বসে আছে এক তরুণী। প্রতিদিনে কয়েকটা শিফটে কেউ না কেউ থাকে এখানে। বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। হয়ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও টিউশন ফি আর জীবনধারণের খরচ জোগাতে এই শনিবার সকালে হার্ট হাউসের জিমে কাজ করতে হয় তাদের। এই সময়টা অত মানুষ থাকে না জিমে। হিম হিম শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠতে কারই বা ভাল লাগবে ধুলোমাটি মাখিয়ে ঘর থেকে বেরুতে। মানুষ নেই, হয়ত তাই ল্যাপ্টপ খুলে নিজের কাজ এগিয়ে নেবার জন্য এটাই ভাল সময়। জিম থেকে বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখে আবার বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম।

বিছানায় অসময়ে অলস গড়াগড়ি না করতে পারলে আবার কিসের ছুটির দিন? তাই দুপুরবেলা চোখ খুলে বেশ তাজা লাগছিল। কিন্তু বের হতে হবে। রনির বাসায় যাব বিকেল ৪টায়, তার আগে এক বন্ধুকে তুলতে হবে তার বাসা থেকে। কিন্তু শেরবর্ন আর ব্লুর ওয়েস্টের ইন্টারসেকশনের কাছে বহুতল ভবন তৈরির কাজে এই ছুটির দিনে যে পরিমাণ জ্যাম লেগে আছে তাতে ৪টায় ওর বাসায় পৌঁছুতে পারব কিনা কে জানে! গাড়িতে বসে জ্যামের মধ্যে বিরক্ত হচ্ছি, ওদিকে ফোন বাজছে। এমনিতে ফোন না ধরলেও গাড়িতে বাজলে মাঝে মাঝে ধরি। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম হাসান মাসুকের নাম। এই ফোনটা সম্ভবত ধরতে হবে।
মাসুক জানতে চাইল কয়টায় পৌঁছব? বললাম, ‘রাস্তার অবস্থা ভাল না, তুই আমি ফোন না করলে বের হইস না।’ মাসুককে শেষমেশ বাসা থেকে তুলতে পারলাম সাড়ে ৪টার দিকে। ও আমার কলেজের বন্ধু, মেঘের বাবা। কবিতা লেখে। সুদর্শন, প্রেমিক পুরুষ হিসেবে ভাল নাম-ডাক আছে টরন্টোতে। সরকারী চাকরি করে। বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই এখন কানাডা সরকারের অংশ। এখানে না এলে জানতাম না এত অভিবাসী ভিন দেশে সরকারী চাকরি পায়। রনির বাসায় পৌঁছে দেখলাম শরীফ, সাকিব বসে আছে।

টেবিলে মুরগির মাংস ভাজা। সঙ্গে একটা সালাদ। রাতে রনি আর ঝুমের রান্না ফ্রাইড রাইস, গরুর মাংস আর চিংড়ির তরকারি খেলাম। খুব মজা হয়েছিল। টরন্টোর গ্রীষ্ম শেষ, হেমন্তের এই শুরুটা দেশের সবচেয়ে শীতের দিনের চাইতেও ঠা-া। আমরা ওর বাড়ির পেছনের উঠোনে বসেছিলাম। রনি গরুর মাংস রান্না করেছিল মাটির চুলায়। আইনজীবী ভদ্রলোক রান্না-বান্নায় খুব পারদর্শী, সঙ্গীতেও। ভীষণ মিশুক। রাতে মাসুককে তার বাসায় নামিয়ে ফিরতে ফিরতে বেজে গেল ১০টা। এর আগে ড্যানফোর্থের বাঙালী দোকান ঢাকা কাবাবে নেমে এক পেয়ালা গরম চা খেয়ে নিলাম। একাই।

বাসায় এসে হাল-জমানার বহুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলাম। আমার টিকটকে বিচরণ বিড়ালের ভিডিও দেখার জন্য। গত দু’বছর ধরে লিলি নামে একটা ২৩ বছর বয়সী বিড়ালকে টিকটকে ফলো করতাম আমি। ২৩ বছর বিড়ালের জন্য অনেক বয়স। বলা হয় বিড়ালের ১ বছর সমান মানুষের ১০ বছর বয়স। অর্থাৎ একটা ২৩ বছর বয়সী বিড়ালের বয়স একজন ২৩০ বছর বয়সী মানুষের সমান। খুব কম বিড়ালই ১০ বছরের বেশি বাঁচে। লিলি আর তাকে যিনি পালতেন, সেই ভদ্রলোকের ভিডিওগুলো আমি খুব মন দিয়ে দেখতাম। কী যে ভীষণ মায়া তাদের মধ্যে।

মধ্য বিশ বছরে লিলিকে পালন শুরু করা ভদ্রলোকের বয়স এখন চল্লিশের ঘরে। লিলি মারা গেছে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২। ভদ্রলোকের বুকে মাথা রেখে। লিলির মৃত্যুর আগে তার শেষ হার্ট-বিটের শব্দ রেকর্ড করে রেখেছেন ভদ্রলোক। সামাজিক যোগাযোগ মাধমে লাখ লাখ মানুষ লিলির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে, কেঁদেছে হাজারো মানুষ। বিড়ালের প্রতি মানুষের এই ভালবাসা আমাকে বিস্মিত করত এই দু’বছর আগেও। কিন্তু যখন থেকে আমি মিকিকে ঘরে এনেছি, তখন থেকে বুঝেছি এই নিঃস্বার্থ ভালবাসা অমূল্য।

২১ সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিন ছিল। কিন্তু লিলির মৃত্যুতে ভীষণ মন খারাপ ছিল আমার। প্রতি মঙ্গলবার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর স্কারবোরো ক্যাম্পাসে জনস্বাস্থ্য পড়াই আমি রাত ৯টা পর্যন্ত। বাসায় ফিরতে সাড়ে ১০টা বেজে যায়। সেদিন এসে দেখলাম অহনা তখনও ঘুমোয়নি, জেগে আছে। কেক নিয়ে আমি কাটব বলে। ঝটপট কেক কেটে মেয়েকে ঘুমুতে পাঠালাম। এদিকে মাথার ভেতর ঘুরছিল মিষ্টি মেয়ে বিড়াল লিলির কথা। লিলির মানুষ বাবা ভদ্রলোকের কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছিল।

কিভাবে থাকবেন তিনি এখন? বিড়াল শিশুটা ছাড়া তার আর কোন সঙ্গী দেখিনি গত দুবছর। যাই হোক, আমার জন্মদিনে অনেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ফেসবুকের ইনবক্স ভরে গেছে প্রায় হাজারো ছোট মেসেজে। নিজের ওয়ালে পোস্ট দিয়ে বা আমার ওয়ালে কমেন্ট করেও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে। শুভেচ্ছা এসেছে হোয়াটসএ্যাপে, ভাইবারে আর কত মাধ্যমে। সবাইকে আজকে টরন্টোর চিঠির মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা জানিয়ে দিলাম।
এদিকে ইরানে যথাযথভাবে বোরকা পরেনি বলে মাশা আমিনি নামে এক তরুণীকে পুলিশের হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগে সে দেশে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে সাংবাদিক আনিস আলমগীর ভাই ১৯৯৭ সালে তার ইরান জীবনের অভিজ্ঞতার কথাও জানলাম ফেসবুকে। তবে যারা ইসলাম ধর্মে পূর্ণ আস্থা রেখে বোরখা পরেন তাদেরকে শ্রদ্ধা করি। আবার যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন এবং বোরখা-হিজাব পরেন না, তাদের প্রতিও আমার কোন বিদ্বেষ নেই।

অন্যদিকে যারা ইসলাম ধর্ম মানেন, কিন্তু বোরখা পরতে চান না, সেটি তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা। কেননা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গাটা ওই ব্যক্তি ও তার সৃষ্টিকর্তার মধ্যকার বিষয়। ধর্ম আর রাষ্ট্র দুটো ভিন্ন বিষয়। একজন মন্তব্য করেছে ইরান একটি ইসলামী রাষ্ট্র। তাই ইরান ইসলামী আইনে পরিচালিত হবে। আমরা এটার সঙ্গে একমত নই। নির্ধারিত জীবনধারায় কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। পৃথিবীর কোন দেশের সংবিধান ইসলাম বা হিন্দু বা খ্রীস্টান বা ইহুদি ধর্মের প্রচলিত গ্রন্থের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে পারে না।

ইরান, ভারত, ভ্যাটিকান সিটি বা ইসরাইলসহ বহু দেশ ধর্ম নিয়ে যা করছে তা গায়ের জোরে করছে এবং রাজনৈতিক কারণে । আজ থেকে ৫০ বছর পর পৃথিবীতে ধর্মকেন্দ্রিক কোন সংবিধান থাকবে না বলেই বিশ্বাস করি। এত কিছু বলার মূল কারণ হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেয়া। মানুষকে তার জীবনধারণের প্রক্রিয়া বেছে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। অবশ্যই নিজের জীবনধারা দিয়ে অন্যের জীবনে ব্যাঘাত ঘটানোর সুযোগ থাকা উচিত নয়।

মদ খেয়ে গাড়ি ফুটপাথে তুলে দেয়া, গাঁজা খেয়ে পাশের বাসার বাচ্চাকে অসুস্থ করে দেয়া, ওড়না না পরার জন্য রাস্তায় কাউকে হেনস্থা করা, কাউকে ছাগল বলে গালি দেয়া- এগুলো অন্যের জীবনে অযাচিত হস্তক্ষেপ। আবার কেউ বিবস্ত্র হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকতে পারে না। এটাও ব্যক্তি স্বাধীনতা নয়। কারণ রাস্তায় অনেক মানুষ চলাচল করে। এটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ঠিক যে কারণে বাচ্চাদের চলচ্চিত্র দেখাতে নিয়ে গেলে সেটি কত বছর বয়সীদের জন্য উপযুক্ত তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মূল কথা কোন ধর্মের আইন রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেবেন না দয়া করে।

ব্যক্তিকে তার মতো চলতে দিন, যতক্ষণ না সে অন্যের ক্ষতি করে। কানাডায় সুন্দর কাঁচের দেয়াল ঘেরা দোকানে ১০-২০ ডলারে রাস্তার পাশে থরে থরে সাজানো হাজার হাজার মদের বোতল দেখা যায়। কাউকে বলতে শুনিনি, মদের বোতল ঢেকে রাখে না বলে ভাই খেয়ে ফেলেছি, আমার কী দোষ! যে যার বিশ্বাস অনুযায়ী চলে। কেউ বোরকা না পরলে, হিজাব না পরলে, পাগড়ি না পরলে, মদ খেলে, জুয়া খেললে, হাফপ্যান্ট পরলে, জুমার নামাজ না পরলে, পূজা না দিলে, গঙ্গায় ডুব না দিলে, গির্জায় না গেলে আপনার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগলে, আপনি তার থেকে দূরে থাকুন। বন্ধু ও সঙ্গী নির্বাচন সঠিকভাবে করুন।

যাদের জীবনধারণ ভাল লাগে তাদের সঙ্গে সময় কাটান। পৃথিবীতে ৮০০ কোটি মানুষ। আপনার মেশার মতো ১০ জন মানুষ পাওয়া কঠিন কিছু না। কিন্তু আপনার মত ও বিশ্বাসে ৮০০ কোটি মানুষকে দীক্ষিত করতে যাবেন না, অন্তত বাধ্য করবেন না। বরং পারলে নিজেকে এতটাই উন্নত করুন যাতে আপনি বিশ্বের সামনে আদর্শ হিসেবে দাঁড়াতে পারেন। অজ-পাড়াগাঁ, গ্রাম, অন্ধকারের ঘুপচি থেকে ভোতা ঢাল তলোয়ার নিয়ে গায়েবি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গেলে কোনদিনও এগোতে পারবেন না।

আপনার ধর্মের ১০০ জন নোবেল বিজয়ীকে মানুষের সামনে নিয়ে আসুন, ১০০ জন অস্কার বিজয়ীকে সামনে নিয়ে আসুন, ১০০টা ধর্মীয় গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করুন আমেরিকা-কানাডায়, বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে মানুষের জীবনে আপনার আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু জঙ্গী সন্ত্রাসী কার্যক্রম, দা, বঁটি, জোর-জুলুম, চড়-থাপ্পড় দিয়ে আর কত? কেতাবি আইন দিয়ে মর্তের দুনিয়ায় মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানাই। মাশা আমিনির হত্যাকা-সহ এখন ইরানে যা হচ্ছে তারও নিন্দা জানাই।
কানাডায় এখন হেমন্তকাল। শীত আসি আসি করছে। বাংলাদেশে এখনও হেমন্ত আসেনি। গ্রীষ্ম আর বর্ষা চলছে। শরৎ আর হেমন্ত আর আসে না এখন। তাই কেউ কেউ বলছিল আমার লেখার শিরোনাম চলে যায় হেমন্তের দিন না হয়ে চলে যায় বসন্তের দিন কেন হলো! ফাইয়াজ বলে তোর লেখায় যা লেখা থাকে পড়তে হয় তার চাইতে বেশি। এক লাইনের লেখার ভেতরে লুকানো থাকে আরও তিনটা লাইন। ভেতরের লেখাগুলো অদৃশ্য কালিতে লেখা থাকে, সবাই পড়তে পারে না।

কেউ কেউ এটাকে লেখকের ব্যর্থতা বলতে পারেন, কেউ কেউ বলবেন নির্দিষ্ট ঘরানার পাঠকের লেখক। এই যে যা লিখি, আসলে পড়তে হয় তার চাইতেও বেশি, একে জনস্বাস্থ্যের কাঠগড়ায় বলি খধঃবহঃ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয. খুব করে চাই যিনি পড়বেন, তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে পড়বেন, কল্পনা করে নেবেন লেখকের জীবনটাকেও। ইবযধারড়ৎধষ ংপরবহপব-এ এভাবে জীবনকে জানতে চাওয়ার প্রচেষ্টাকে বলি-আজ থেকে ১৫ বছর আগেও একজন লেখকের গল্প বংংবহঃরধষরংঃ ঢ়ধৎধফরমস. বা কবিতা পড়ে তাকে ধরে জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল না- এটা বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন।

চিন্তা করেন হুমায়ূন আহমেদকে কেউ তার লেখার কোন অংশের একটা ব্যাখ্যা দিতে বলছে। অসম্ভব! হুমায়ূনের বেশিরভাগ লেখাই খুবই সহজবোধ্য ছিল, কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক, কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অথবা শহীদুল জহিরের লেখা, যা পড়তে ও বুঝতে পাঠককে চিন্তা করতে হয়, ভাবতে হয়, বুঝতে হয়, জানতে হয় - তাদেরকে আজকের বেশিরভাগ পাঠক কি আদৌ পড়তে চায়? এখনকার নাম করা লেখকদের ফেসবুকের ওয়ালে গিয়ে যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করা যায়, সম্ভবত এ কারণে পাঠক হিসেবে আমাদের চিন্তার ইচ্ছা বা আগ্রহ উবে যাচ্ছে।
যাই হোক হেমন্তকালে চলে যায় বসন্তের দিন বলতে বোঝাচ্ছিলাম মানুষের জীবনের কথা। ক্ষুদ্র এই মানবজীবন চোখের পলকে অতিক্রান্ত হয়। জীবনের এই সুন্দর সময়, যাকে মনে হয় বসন্তের মতো রঙিন, ঘটনাবহুল, তা নিমিষেই হারিয়ে যায়। সূর্যের আলোকচ্ছটা ক্রমশ ম্রিয়মান হয়।
চলে যায় বসন্তের দিন...

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
টরন্টো, কানাডা

×