ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার বাংলা গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা-২

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২ অক্টোবর ২০২২

সোনার বাংলা গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা-২

.

বাংলাদেশে পা রেখেই তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ হাজার হাজার নেতা-কর্মীর চোখে সেদিন ছিল আনন্দাশ্রু। অসামান্য যোগ্যতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা ঠাঁই করে নিলেন জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায়।
রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের দল তখন প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। তাদের তান্ডবে মুখ খোলার সাহস নেই কারও। জাতির এ ঘোর অমানিশাকালে আলোকবর্তিকা হয়ে দেশে ফিরে এসে নির্যাতিত-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। গণমানুষের মনে আশা ও সাহসের সঞ্চার হলো। তিনি দেখলেন, মুক্তিযুদ্ধের সেই বাংলাদেশ আর নেই। জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের চরিত্রকে বদলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের চার স্তম্ভ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। অবৈধ ও অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় বসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন করছেন। জাতির এ ঘোর অমানিশাকালে আলোকবর্তিতা হয়ে দেশে ফিরে এসে নির্যাতিত-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থাকতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাবজেক্ট কমিটিতে আলোচনা উঠল সভাপতি নির্বাচনের। দলীয় নেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কারণ ঐকমত্য না হলে দলের ভাঙ্গন নিশ্চিত। এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে হঠাৎ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়লেন নেতা-কর্মীরা। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অসহায় এবং অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। শেখ হাসিনার নাম ঘোষণায় তারা যেন পূর্ণতা পেলেন। যেন অভিভাবক পেলেন। দল যেন আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেল। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা শুধু দলটির সভাপতিই হলেন না, ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করলেন উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এ রাজনৈতিক দলটিকে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন তিনি। এর পরই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন।  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে কারাগারে। তাঁকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ২২ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন পর্বতের মতো অটল। তাঁর দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পথ বেয়ে বাংলাদেশে এগিয়ে গেছে জনতার মুক্তির আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রামের প্রথম সুফল পান শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের দ্বারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হওয়ার দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তিনি সরকার গঠন করেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সরকার পরিচালনায় তাঁর দূরদর্শিতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে শুরু হয় বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অগ্রযাাত্রা। খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচী এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচী- দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তিনিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু করেন শেখ হাসিনা। যা ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য অর্জন।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০১৮-এর সাধারণ নির্বাচনে ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রয়েছেন। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের কারণেই দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে আওয়ামী লীগ চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে এবং বর্তমানে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন।
এ দীর্ঘ সময়ে শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে (২০০৯-২০১৩) বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪  শতাংশ থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মেডেল গ্রহণ ইত্যাদি।
২০১৪-২০১৮ মেয়াদে সাফল্যের মধ্যে ছিল বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ ইত্যাদি।
চতুর্থ মেয়াদে এ পর্যন্ত অর্জিত উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তভুক্তিকরণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া এবং ঢাকায়  মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলা শহরের সংযোগ সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ি বহুমুখী প্রকল্পসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে। সব বিভাগে আইসিটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ মার্কিন ডলার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে শেখ হাসিনার পদক্ষেপে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ ভাল আছে। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, দি ইকোনমিস্ট, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য গভীর অনুপ্রেরণাদায়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শেখ হাসিনা নিয়েছেন যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। মূলত বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি হতে পারে সবচেয়ে বড় অনুঘটক।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়ায় যে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন তারই পথপরিক্রমায় ২০১৮ সালের ১২ মে  শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশের যোগাযোগ মাধ্যমকে বিশ্ববাসীর কাছে নতুনভাবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তথ্যপ্রযুক্তি হতে পারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যবদলের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এ লক্ষ্যে তিনি কম্পিউটার আমদানির  ওপর শুল্ক প্রত্যাহার এবং মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙ্গে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসেন। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিক্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঘোষণা করেন রূপকল্প-২০২১। তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এটি ছিল একটি পরিপূর্ণ সনদ। আর এ রূপকল্পের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব  দিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক  উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা, কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনসহ বিভিন্ন সেক্টরেই আজ ব্যবহার হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাধান। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে চারটি প্রধান স্তম্ভ সবার জন্য কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্মেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনের বাইরে করোনাকালীন সঙ্কট মোকাবেলায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে সরকার।
১ অক্টোবর ২০২২

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক

[email protected]

ww w.bijoyekushe.net

 

×