ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আঁখির চোখে কেন বেদনাশ্রু

মোঃ আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১ অক্টোবর ২০২২

আঁখির চোখে কেন বেদনাশ্রু

আঁখির বাসায় হানা দেয় পুলিশ

প্রতিহিংসা তুষের অনলের মতো অনন্তকাল জ্বলতে থাকে। বাংলাদেশে একটি চক্রের মধ্যে সেটা রয়েছে। এই চক্র সম্পর্কে বলার আগে জরুরী বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমবারের মতো সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলকে সংবর্ধনা জানাতে পুরো দেশ আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছিল। আর সেদিনই চ্যাম্পিয়ন দলের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য দেয়াল বা ডিফেন্ডার আঁখির বাসায় হানা দেয় পুলিশ। বাড়ি করার জন্য আঁখির পিতাকে সরকার এক খণ্ড খাস জমি দান করে। সেই জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক উত্থাপন করা হয়েছে। একটি চক্র মামলা করেছে।

তড়িঘড়ি করে একজন এস আই ও একজন কনস্টেবল মামলার নোটিস নিয়ে আঁখির বাড়িতে গিয়েছে,  তার পিতার নিকট থেকে নোটিস গ্রহণের প্রমাণ অর্থাৎ দস্তখত আনার জন্য। দস্তখত দিতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তার পিতার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ভয়ভীতি দেখায় এবং বকাঝকা করে। সেই এসআই এবং কনস্টেবলকে পরবর্তীতে ক্লোজ করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় বিষয়টি তেমন জরুরী ছিল না।
মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায় আদালতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওয়ারেন্ট তামিল হয় না। দীর্ঘদিন অকার্যকর অবস্থায় পড়ে থাকে। অপহরণ ও ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় অনেক সময় পুলিশ গুরুত্ব দেয় না। আঁখির বাবা ফৌজদারি অপরাধ করেননি, তার নামে কোন ওয়ারেন্ট নেই। শুধু মামলার নোটিস গ্রহণ করে তার কাছ থেকে একটি দস্তখত নিয়ে আসতে হবে। মামলাকারীকে খুশি করতে এত তড়িঘড়ি কেন? সাধারণ একটি বিষয়কে অসাধারণ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ আঁখির বাসায় হানা দেয়।

অথচ আঁখির বাবা মা সে সময় দেশবাসীর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করছিল। মামলার নোটিস দুই দিন পর পৌঁছালে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে স্থানীয় পুলিশের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল কেন? পুলিশের ওপর কিসের চাপ ছিল? লেনদেন এর চাপ, ওপরের চাপ, প্রতিহিংসার তাগিদ, নাকি অন্যকিছু? প্রতিহিংসার তাগিদ একটি বিশেষ চক্রের সদস্যের মধ্যে কাজ করে? তাহলে ক্লোজড হওয়া পুলিশ সদস্যদ্বয় কি বিশেষ কোন চক্রের সহযোগী? বিষয়টিকে হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই।   
ওই ঘটনার কুশিলবরা বরফ খ-ের মাথা মাত্র। যার নিরানব্বই ভাগ থাকে পানির নিচে। এই বরফ খ-ের আঘাতেই বিশে^র সর্ববৃহৎ জাহাজ টাইটানিক পানির নিচে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।  কাজেই বরফের অদৃশ্যমান অংশ আবিষ্কার করতে হবে। অদৃশ্যমান অংশ থেকে বিভিন্ন অপকৌশলে দূরবর্তী লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। এই চক্র বারগেইনিং ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং ঘটনা ঘটানোর পর বারগেইনিং করে বা সাত পাঁচ বুঝিয়ে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রক্ষা করে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আঁখির পিতা-মাতাকে অপমান করার বিষয়টিও ধামাচাপা পড়ে যাবে। অদৃশ্যমান চক্র সেটি করবে। একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খায়। পুলিশ এতটা অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল কেন? নগণ্য একটি বিষয় নিয়ে আঁখির পিতা-মাতাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হলো কেন? এই অতি উৎসাহ প্রয়োজনের জায়গায় দেখালে দেশে ধর্ষণ, অপহরণ, পেশিশক্তির ব্যবহার, চাঁদাবাজি ও খুন অনেক কমে যেত।  
মহিলা ফুটবল দলের কঠোর সাধনায় নেপালের মাটিতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে, জাতীয় পতাকা শোভাবর্ধন করেছে, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের জন্য অমূল্য গৌরব ও সম্মান অর্জিত হয়েছে, যা অর্থ দিয়ে অর্জন করা যায় না। আঁখি সেই জাতীয় বীরদের একজন। অথচ কোন অপরাধ না করেও আঁখির পিতা-মাতা পুলিশ কর্তৃক সামাজিকভাবে হেনস্তা হয়েছে। পিতা-মাতার কাছে আঁখির ইজ্জত সম্মান কোথায় থাকল? এর পেছনে অবশ্যই একটি চক্র জড়িত। এটি কাকতালীয় কোন ঘটনা নয়।

যে চক্র মামলা করেছে তারা জেনেশুনেই পরিকল্পিতভাবে করেছে। তারা জানে আঁখি দেশসেরা একজন ফুটবল খেলোয়াড়। কাজেই তাকে বাধাগ্রস্ত করতে হবে। তাদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় থাকলে হয়ত বাংলা ভাই বাহিনী দিয়ে আরও ন্যক্কারজনকভাবে বাধাগ্রস্ত করত। কিন্তু এখন ভিন্নকৌশলে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে। মামলাকারীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেকটাই আবিষ্কার হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো সেটি হয়ত হবে না। কেননা, ওই চক্র প্রশাসনে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে। এরা অনেকই ঘটাচ্ছে, কিন্তু সরকারের ভেতরে তাদের শক্তিশালী ও সুসংহত অবস্থান থাকার কারণে এরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
এই চক্রই মহিলা ফুটবলারদের বেতন-ভাতা ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতার চেয়ে বহুগুণ নিচে করে রেখেছে। যাতে নিরুৎসাহিত হয়ে নারীরা ফুটবলকে কেরিয়ার হিসাবে বেছে না দেয়। মহিলা ফুটবল দলের প্রত্যেক সদস্য দরিদ্র পরিবারের। মহিলা ফুটবল দলে একজনও নেই যিনি সচ্ছল পরিবারের সদস্য। এটি জাতির জন্য অহঙ্কারের যে, দরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়েও মহিলা ফুটবল দলের প্রতিটি সদস্য এখন জাতীয় বীর। তারা বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। 

সাধারণত সাধারণ পরিবারের সদস্যরাই জাতির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। আমাদের সাতজন বীর শ্রেষ্ঠ সবাই সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন। দুজন পুলিশ সদস্য (একজন এসআই ও একজন কনস্টেবল) যারা আঁখির বাসায় গিয়েছিল তাদের ক্লোজড করা হয়েছে। এভাবে প্রলেপ দিয়ে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়া ঠিক হবে না।
আঁখির বাসায় পুলিশের হানা ঘটনাটিকে টেস্ট কেস হিসেবে নিয়ে বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা উচিত। তাহলে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে। মনে রাখতে হবে যে, যারা নারীদের খেলাধুলায় দেখতে চায় না, যারা নারীদের সামরিক বাহিনীতে দেখতে চায় না, যারা নারীদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখতে চায় না, যারা পহেলা বৈশাখের উৎসব দেখতে চায় না, যারা নারীদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, সেই চক্র ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

এই চক্র মুক্তিকামী মানুষের আনন্দ উল্লাস ও হাসিকে সহ্য করতে পারে না। এই চক্রই বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে জাতির কম্পাস জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মূল করেছে। এই চক্রই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জহির রায়হানকে মিরপুর এলাকায় গুম করেছে। এই চক্রই রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষের আনন্দ নষ্ট করেছে।
গত ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি অর্জনের পর বিজয়ী ক্রিকেট দলকে সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য তেমন সাড়া লক্ষ্য করা গেল না, যা দুুঃখজনক। মহিলা ফটবলারদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শনে অনেকেই হতাশ হয়েছে। মহিলা ফুটবল খেলোয়াড় ও ক্রিকেট খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতার আকাশ-পাতাল পার্থক্য কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দেশের স্বার্থেই সেটা প্রয়োজন। সরকারপ্রধানের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সহযোগিতায় দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিভাময়ী নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটেছে এবং অনেক উন্নতি হয়েছে। সাফ মহিলা ফটবল ট্রফি জয় তারই প্রতিফলন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় বীরদের এককোটি টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।
সৌদি আরবে মহিলারা এখন গাড়ি ড্রাইভ করতে পারেন, পাসপোর্ট করে একা বিদেশে গমন করতে পারেন, একা হজব্রত পালন করতে পারেন, একা বসবাস করতে পারেন, পুরুষ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে পারেন, সিনেমা দেখতে পারেন, গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পারেন, হিজাব পরিধান শিথিল করা হয়েছে, কনসার্টে দর্শক হতে পারেন এবং সবচেয়ে অবাক কা- হচ্ছে জেদ্দায় কেবল মেয়েদের জন্য হালাল নাইট ক্লাব চালু হয়েছে।

সম্প্রতি হিজাব না পরার জন্য ইরানে নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনি নামের এক তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।  সেই মৃত্যু ইস্যুতে বর্তমানে ইরানের প্রায় ৮০টি শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে। এ যাবত ৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, গ্রেফতার করা হয়েছে দুই হাজার এবং নারীরা প্রকাশ্যে হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মুসলিম বিশ্বে নারীদের স্বাধীনতা এখন সময়ের বিষয় মাত্র।
বাংলাদেশে জেএমবি কর্তৃক মাজারে মাজারে জবাই করে মানুষ হত্যা, একই দিনে ৬৪টি জেলায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো, বাংলাভাই বাহিনী দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রগতিশীল মানুষকে পিটিয়ে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা, বাউল শিল্পীদের যন্ত্রপাতি আগুন দিয়ে পোড়ানো, ব্লগারদের কুপিয়ে হত্যা ইত্যাদি ভয়াবহ বীভৎস কর্মকা- হচ্ছিল। সরকার সেই ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে যারা নীরবে সরকারে অবস্থান নিয়ে মৌলবাদী দর্শনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পিত কর্মসূচী নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। জেএমবিরা প্রকাশ্যে বীভৎস কর্মকা- করছিল। কাজেই সহজে তাদের দমন করা গেছে। কিন্তু সরকারে থাকা মৌলবাদের দোসররা সরকারী ক্ষমতা হাতে নিয়ে মৌলবাদের পক্ষে কাজ করছে। যে কারণে এদের দমন করা অনেক কঠিন হতে পারে, কাজেই সময় থাকতে সাবধান। কারণ, এরা সরকারেরই অংশ।

লেখক : সাবেক পরিচালক প্রশাসন, বিএসএমএমইউ
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:)

×